বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমরা তোমাদের পাশেই থাকতে চাই

​বেশ কয়েক বছর আগে ‘রেইন ম্যান’ নামে একটি সিনেমা দেখেছিলাম, যে সিনেমা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়ে। এরপরই দেখেছি ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ ও ‘মাই লেফট ফুট’ মুভিটি। সিনেমা তিনটি যেমন ছিল চমৎকার, জীবন ঘনিষ্ঠ, তথ্য সমৃদ্ধ, তেমনি ছিল হৃদয় ছোঁয়া। আমি দেখেছি, আর ঝরঝর করে কেঁদেছি।

বেশ কয়েক বছর আগে ‘রেইন ম্যান’ নামে একটি সিনেমা দেখেছিলাম, যে সিনেমা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়ে। এরপরই দেখেছি ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ ও ‘মাই লেফট ফুট’ মুভিটি। সিনেমা তিনটি যেমন ছিল চমৎকার, জীবন ঘনিষ্ঠ, তথ্য সমৃদ্ধ, তেমনি ছিল হৃদয় ছোঁয়া। আমি দেখেছি, আর ঝরঝর করে কেঁদেছি। দেখার পর আমার মনটা এত বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনও এরকম বিষয়ে মুভি দেখবো না। কিন্তু সিজোফ্রেনিয়া, সেরিব্রাল পালসি, সেভান্ট সিনড্রোম ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার যে ধারনা হলো, তা আমাকে অন্য মানুষে পরিণত করলো, আমার চোখ খুলে দিল, আমার অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিলো।

বুঝতে পারলাম সেভান্ট সিনড্রোমে আক্রান্ত একজন মানুষ, যাকে আমরা খানিকটা অস্বাভাবিক বলে মনে করি, কিন্তু সেই মানুষটাই কতটা বেশি জ্ঞান তার মাথায় ধারণ করতে ও সাততাড়াতাড়ি সেই তথ্যগুলো স্মরণ করতে পারে, জেনে অবাক হয়ে গেছি। দেখতে পেলাম শিশুকাল থেকে মানুষটি শুধু তার বাম পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও একসময় সে বিশ্বের সেরা একজন লেখক ও আঁকিয়ে হয়ে উঠেছিল। কীভাবে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত একজন মানুষও হতে পারে দারুণ গণিতবিদ, যার হাতে তৈরি হয় গাণিতিক থিওরি।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন শুধু আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কেই জানতাম। বাসায় ও পৌরনীতি বইতে শেখানো হয়েছিল, ‘খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না’ ‘কানাকে কানা বলিও না’ ‘বোবাকে বোবা বলিও না’, বলিলে উহারা কষ্ট পায়-- ব্যস এই পর্যন্তই। মানসিক প্রতিবন্ধিতা বলে যে কিছু আছে, তা জানতেও পারিনি। এ নিয়ে তেমন কিছু জানানো বা শেখানো হয়নি। আমরা জানতাম কারোও কোন মানসিক ভারসাম্যহীনতা থাকলে তাকে পাগল বলা হয়। আমরাও তাই বলতাম। যেমন, আমার আব্বার বন্ধুর ছেলেটি ছিল আমারই বয়সী। ও খুব এটা বেশি কথা বলতো না, তেমনভাবে মানুষের সাথে মিশতো না, আমরা বেড়াতে গেলে খেলতো না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার ছিলো ও অসম্ভব ভালো ছবি আঁকতে পারতো। যাকে দেখতো, তাকেই হুবহু এঁকে ফেলতে পারতো। আমরা অবাক হয়েছি কিন্তু কখনো বুঝিনি ওর এই গুণটাকে, কেউ কদর করেনি, এমনকি ওর বাবা-মাও নয়। বরং তারাও মানুষজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে এড়িয়ে চলতো।

একইভাবে আমাদের কোনদিনই শেখানো হয়নি ভিন্নভাবে সক্ষম এই মানুষগুলো অন্য জগতের কেউ নয়, ভিনগ্রহের প্রাণী নয়। এরা আমাদের পাশে থাকা মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে অপরিমিত শক্তি। যারা আচার-আচরণে খানিকটা বা অনেকটাই অন্যরকম হলেও, এদের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মেধা। এদের ভালবাসতে হবে, যাতে নিতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সন্তান ভেবে তাকে বুকে টেনে নিতে হবে। আমরা সবাই সবসময় এদের এড়িয়ে চলেছি, এড়িয়ে চলি। ধরেই নেই এরা মানসিক রোগী বা বিকৃতভাবে বলি ‘পাগল’। কোন প্রতিবন্ধী বা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষকে আমরা আমাদের মত করে ভাবতে পারি না। তাদের কষ্ট, চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেই না। তাদের প্রান্তিক করে রাখি, লুকিয়ে রাখি, বঞ্চিত করি সব অধিকার থেকে। আমরা যারা নিজেদের ‘সক্ষম’ বলে মনে করি, প্রকৃতপক্ষে আমরাই সবচেয়ে ‘অক্ষম’ এবং এটা প্রমাণিত।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল একটি বয়স্ক শিশুর কথা যে আমাদের বিল্ডিং-এ ষষ্ঠ তলায় থাকতো তার মায়ের সাথে। আসা যাওয়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত পথে। বাচ্চাটিকে নিয়ে ওর মা যখন চলাফেরা করতেন, তখন তাকে দেখলেই বোঝা যেত দারুণ একটা কষ্ট বুকে চেপে আছেন। উনি খুব সন্তর্পণে, মুখ চোখ আড়াল করে বাচ্চাটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। তাও মাঝেমাঝে তাদের শেষ রক্ষা হতো না। বাচ্চাটি লিফটের ভেতরেই পায়খানা, প্রস্রাব করে ফেলতো। তা নিয়ে এই আমরাই বিরক্ত হতাম, খেদ প্রকাশ করতাম।

তাই হয়তো লজ্জায় ১৭ বছরের ওই ছেলেটির মা মুখ লুকিয়ে চলতেন। প্রতিবন্ধী শিশুটির মা ছিলেন অসহায়, কারণ ডাক্তার বলেছিল প্রতিদিন বাচ্চাটিকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যেতে, নতুবা ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই এই বিরাট সংসারে শিশুটির মা-ই এই অপ্রিয় কাজটি করতে বাধ্য হতেন।

আমাদের বিল্ডিং এর সেই অবুঝ শিশুটি তার মায়ের সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে পরপারে চলে গেছে বছরখানেক আগে। ওর মা কাঁদতে কাঁদতে একনাগাড়ে পাগলের মত বলে চলেছেন, “ওর জন্য আমি ঘুমাতে পারতাম না। শুধু মনে হত আমি ওকে রেখে মারা গেলে, কে দেখবে ওকে? আজকে ও আমার হাতেই মাথা রেখে চলে গেল, আজকে রাতে কি তাহলে আমি ঘুমাবো?” এই প্রশ্নের কোন জবাব হয় না।

আমি এমন আরও একজন মাকে চিনতাম, যে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলেছিলেন, “যদি পারতাম তাহলে আমিই আমার বাচ্চাটিকে গলা চেপে মেরে ফেলতাম। কিন্তু পারিনি, পারবো না। শুধু ভয় হয় আমি আর ওর বাবা না থাকলে এই সংসারে ও কোথায় গিয়ে থাকবে? ওতো তখন এমনিই মারা যাবে, কষ্ট পাবে।” এই কথাটি সে বলেছে আর ঝরঝর করে করে কেঁদেছে। “অথচ কি জানিস, ওকেই আমি আমার তিন বাচ্চার মধ্যে সবচেয়ে ভালবাসি। সারাক্ষণ ওর কথা ভাবি।” আমার এই খালার ছেলেটিও ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছেলেটি মারা যাবার মাত্র একবছর পর, ওর মা মানে আমার খালাও মারা গেলেন। ভাবনাহীন মৃত্যু হলো তার।

এই ‘অটিজম’ এবং ‘অটিস্টিক’ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক পরে এসে জানতে পেরেছি, বুঝতে পারছি এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি। এটি স্নায়ুবিকাশজনিত একটি ডিসঅর্ডার, যা জীবন ধরে চলে। আগে মানুষ এই বিষয়টি বুঝতো না। এখনও যে খুব একটা বোঝে, তা নয়। শহরের শিক্ষিত লোকেরা প্রয়োজনের তাগিদে কিছুটা জানলেও, গ্রামের অগণিত মানুষ কিছুই জানে না। তাদের কাছে এরা ‘পাগল’ বলেই পরিচিত।

প্রতিবন্ধিতা ও অটিজম নিয়ে আমাদের খুব করে প্রচারণা চালাতে হবে, জনগণকে সচেতন করতে হবে। বাবা-মাকে সচেতন করতে হবে যেন তারা তাদের শিশুর আচরণ ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করেন। যেমন শিশুটি কি ঠিক সময়ে কথা বলছে না, আই-কনটাক্ট করছে না, নিজের মত চলছে, রুটিনের বাইরে কিছু করতে চায় না, কোন পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না, একই আচরণ বারবার করে কিনা ইত্যাদি।

যে বাবা মায়ের একটি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চা থাকে, তারা জানেন কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়। এই দেশে, এই সমাজে কি ভয়াবহ প্রতিকূলতাকে তারা মেনে নিয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানকে প্রতিপালন করেন। যেখানে একজন সুস্থ শিশুকেই ঠিকমতো বড় করে তোলা অভিভাবকের জন্য কঠিনতম কাজ, সেখানে একজন শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চার অবস্থা কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

সরকারি এতিমখানা শিশুমণিদের নিবাস, প্রায়ই তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী বাচ্চা কুড়িয়ে পায় বা পুলিশ এসে এখানে দিয়ে যায়। এই বাচ্চাগুলো শুধু অযাচিতই নয়, ভীষণভাবে অযাচিত। ওদের মা বা বাবা প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকত্ব অস্বীকার করে তাদের ফেলে রেখে যায় জলে, জঙ্গলে বা পথের ধারে।

এসব শিশু প্রায় সবধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাবা, মা ছাড়া বিশেষ করে মা ছাড়া কেউ তাদের খোঁজ রাখে না, যত্ন করে না, ভালবাসে না। এদেরকে সবাই মনে করে পরিবার বা সমাজের বোঝা হিসেবে। একজন অসৎ, বদমাশ, লম্পট, খুনিকে সমাজ যতটা না এড়িয়ে চলে, এর চেয়ে বেশি এদের এড়িয়ে চলে। প্রতিবন্ধী বাচ্চা অবহেলিত, অনাদৃত। শহরে, মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারে যদিও এই মানুষগুলোর কিছুটা মূল্য রয়েছে, তাদের কথা পরিবার কিছুটা হলেও ভাবে কিন্তু দরিদ্র পরিবারে এরা শুধুই বোঝা। অনেককেই ব্যবহার করা হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। তবে যেকোন পরিবারেই এই অসহায় মানুষগুলো যতদিন বাঁচে, ততদিনই থেকে যায় সংসারের বোঝা হিসেবে। শুধু তাদের মা বা বাবাই তাদের কথা ভাবে, তাদের ভালবাসে। তবে রাষ্ট্র যদি সত্যিকারভাবেই এদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে পরিবারের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতে পারে। যেমনটা হয়েছে উন্নত বিশ্বে।

আমাদের একটু ভালবাসা, একটু সমর্থন, দৃষ্টিভঙ্গির একটু বদল, একটু উদারতা, একটু হাত বাড়িয়ে দেওয়া বেঁচে থাকার শক্তি যোগাতে পারে এই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোকে। এরাতো আমাদেরই সন্তান, ভিনগ্রহের কেউ নয়। আমাদের সবার ভাবা উচিৎ যেকোন সময়ে, যে কারও সংসারে এমন একটি শিশুর জন্ম হতে পারে, যে সাদা চোখে অক্ষম কিন্তু যে হতে পারে ভিন্নভাবে সক্ষম। এদের প্রত্যেকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের শক্তি, যাকে জাগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব এই আমাদেরই।

অটিস্টিক বাচ্চাকে লুকিয়ে না রেখে তাকে সবার সাথে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে পরিবারকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে। অটিস্টিক বাচ্চার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের বুঝতে পারা। খেয়াল করতে হবে বাচ্চাটির ভিতরে লুকানো গুণগুলো কী কী? তাকে সবসময় উৎসাহিত করতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা চালু হয়েছে দেশে। যদিও সব হাসপাতালে নয়, এমনকি সব চিকিৎসকও জানেন না কীভাবে এই রোগীর সাথে আচরণ করবেন, সব স্কুলে এই বাচ্চাদের পাঠদানের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু তারপরও আমরা আশা করছি-- একদিন আমরাও এদের বুঝবো, বুকে জড়িয়ে ধরবো, ওদের সম্মান করতে শিখবো।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago