মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি

একটা সময় ছিল, যখন এই ঢাকা শহরেই মেলা বসতো। বৈশাখী মেলা, মহররমের মেলা, ঈদের মেলা, দুর্গা পূজার মেলাসহ আরও অনেক মেলা। এখনও মনে আছে চারিদিকে সাজানো মাটির পসরা, তালপাতার বাঁশি, মাটির খেলনা, হরেকরকম ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, হাড়ি-পাতিল, কানের দুল, নাকের নোলক, ক্লিপ-ফিতা, শাড়ি-কাপড়, আলতা-সাবান, দা-খুন্তি, মাকড়ি, বাঁশ-বেতের জিনিস, পাখা, চালুনি, ঘর সাজানোর উপকরণ, নাগরদোলা, চটপটি, কটকটি, ফানুস—কী নেই সেখানে। কী ছেড়ে, কী কিনবো অবস্থা। আমি ছোট্ট মানুষ, বাবা-মায়ের হাত ধরে আজিমপুর মাঠে গিয়েছিলাম মহররমের মেলায়। যতটুকু মনে পড়ে নাগরদোলায় উঠেছিলাম, হাওয়াই মিঠাই খেয়েছিলাম। তারপর ব্যাগ ভর্তি মাটির খেলনা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম।

যত বড় হয়েছি, মেলায় যাওয়াও কমে গেছে। এখনতো মনে হয় শহরের মেলা হারিয়েই গেছে। শহরের মেলা স্থান করে নিয়েছে ব্যন্ডশিল্পী মকছুদের গানে—“মেলায় যাইরে মেলায় যাইরে, বাসন্তী রং শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়।”

কিন্তু এরপরও আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এখনও নানাধরনের মেলা প্রচলিত আছে। বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে আছে মেলা। কবে, কোথায়, কিভাবে মেলার শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও, এটা ঠিক যে প্রতিটি মেলার সাথে একটি কাহিনী বা গল্প প্রচলিত আছে। লোকমুখে তা এলাকায় প্রচারিত হতে হতে সেভাবেই একদিন প্রচলিত হয়ে যায় মেলা। যেমন, বগুড়া জেলার পোড়াদহের মাছের মেলা হচ্ছে বহু বহু যুগ ধরে। প্রচলিত গল্প হচ্ছে, একবার নাকি পিঠে এক সোনার ঝুড়ি নিয়ে একটি বিশাল কাতলা মাছ নদীতে ভেসে ওঠে। তাকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ভিড় করতে থাকে। সেই মাছ দেখতে সেখানে আসেন একজন সন্ন্যাসী। যিনি এখানে আশ্রম গড়ে তোলেন এবং সেই থেকে শুরু হয় লোক সমাগম ও ক্রমশ তা মেলায় রূপ নেয়, যা এখনও চলছে। এই মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় মাছ।

এভাবেই এলাকায় এলাকায় বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে মানুষ একত্রিত হতো। মানুষের এই মিলিত হওয়াটাই মেলায় রূপ নিয়েছিল বহু যুগ আগে। এই মিলনকে ঘিরেই শুরু হল পসরা সাজিয়ে বসা। জমিদার, নবাব, রাজারাজরা, ধনী পরিবারগুলোর বিশেষ অবদান আছে মেলা জমিয়ে তোলার পেছনে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে যে তেরো পার্বণ হয়, এর প্রায় প্রতিটির সাথে কিন্তু মেলা জড়িয়ে আছে। মেলা ছাড়া তাদের কোন উৎসব হয় না। যেমন রথযাত্রার মেলা, আশ্বিনী পূজার মেলা, মাঘী পূর্ণিমার মেলা, চড়ক পূজার মেলা, ঝুলনযাত্রার মেলা, কার্তিকব্রতের মেলা, রাস মেলা এরকম আরও অনেক। বাংলাদেশের লালমনিরহাটে হয় বউ-শাশুড়ি মেলা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইলে হয় জামাইমেলা। সবই তিনশো-চারশো বছর ধরে চলে আসা মেলা। ফরিদপুরে চলে আসছে কবি জসীমউদ্দীনের মেলা। আর আছে কুষ্টিয়ার লালন আখড়ার লালনমেলা ও সাগরদাঁড়ির মধুমেলা।

সুন্দরবনের দুবলার চরে অনুষ্ঠিত রাসমেলাটি দেখার জন্য বহু জায়গা থেকে সেখানে মানুষ সমবেত হয়। অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে এই মেলাকে ঘিরে। যত গল্পই থাকুক, এই মেলায় গিয়ে আমাদের এক বন্ধুর যা হয়েছিল, তাও কম মজার ছিল না। সাধারণত সনাতন ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা সূর্যোদয়ের আগে সাগরের পাড়ে বসে প্রার্থনা করেন। সূর্যোদয়ের পর জোয়ার এলে, সেই পানি স্পর্শ করে তারা সাগরে স্নান করেন। তাদের মতে এই স্নানের সাথে সাথে সব পাপ সাগরে মিশে যায়। অতি উৎসাহী আমাদের সেই মুসলিম বন্ধুটিও এই স্নান পর্বে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, সে পুণ্য স্নানে নামার পর আর পানি থেকে উঠতে পারছিল না। বিরাট বিপদ ঘটলো তার কপালে। কারণ তার কাপড় সাগর পাড় থেকে কুকুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পরে বহু কষ্টে তাকে এক টুকরো কাপড় সংগ্রহ করতে হয়েছিল। বোধ করি কুকুরটি বুঝতে পেরেছিল এ একজন ভুয়া পুণ্যার্থী।

আগে নতুন ধান উঠলে গ্রামে-গঞ্জে নবান্নের মেলা হত। এখনো কোথাও কোথাও হয়। এসময় মানুষের হাতে পয়সা থাকে বলে ধান চাল বিক্রির সাথে সাথে কেনাকাটাও হয়। অনেকে মনে করেন কোন উৎসবকে সামনে রেখে মানুষের এই একসাথে হওয়া ও কেনাবেচা করার মূল ধারণাটি ‘গ্রামের হাট’ থেকে এসেছে। গ্রামে হাটবার কিন্তু দারুণ আনন্দের একটি দিন। সেদিন সকাল থেকে গৃহস্থ বাড়িতে হৈ চৈ, আনন্দ-বিনোদন শুরু হয়ে যায়। গাড়ি-ঘোড়া তৈরি থাকে। বাড়ির পুরুষরা হাটে যায়। বেচাকেনা করে ফিরে আসে। বাড়িময় নতুন জিনিষের ছড়াছড়ি, চুলায় রান্নার ঘ্রাণ। সব পরিবারেই হাটবারের জন্য ও মেলার জন্য কমবেশি আলাদা একটা বাজেট থাকে।

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফলের মতই একটি বিষয় বাংলার মেলা। এটি বাঙালির ঐতিহ্য, ভালোবাসা। বাংলাদেশে এমন কোন অঞ্চল নেই, যেখানে বছরে একবার মেলা বসে না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মেলাগুলো বসে সাধারণত নির্দিষ্ট কোন জায়গায়—যেমন বড় বটের ছায়ায়, অশ্বত্থ গাছের নীচে, পুকুর বা নদীর পাড়ে, স্কুলের মাঠে, মন্দিরের সামনে বা মাঠে-- যেখানে অনেক জায়গা, লোক জমায়েত হতে পারে। মেলাতে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, ভক্তিগীতি হয়। হয় সার্কাস, পুতুল নাচ।

চৈত্র মাসের শেষ দু’দিন ও পহেলা বৈশাখকে নিয়ে আমাদের পার্বত্য চট্রগ্রামের আদিবাসীদের উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। তিনটি নৃগোষ্ঠীর ভাষা থেকে তিনটি অক্ষর নিয়ে এসেছে বৈসাবি শব্দটি। ত্রিপুরাদের নতুন বছর ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব। পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব এই বৈসাবি। পরপর তিনদিন হলেও তিনদিনই কিন্তু একধরনের অনুষ্ঠান হয় না। তবে মেলা চলে তিন দিনব্যাপী। নিজ নিজ প্রথা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা এটা উদযাপন করে। এই উৎসবে তারা মানুষ, প্রকৃতি, পশুপাখি সবার মঙ্গল কামনা করে। কারণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী মনে করে প্রকৃতি তাদের মা -- এই মা ভাল না থাকলে মানুষও ভাল থাকবে না।

“আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি আর আগের মত বাজে না” – গানের এই কথার মত মেলা সত্যি আর আগের মত নেই। মেলার প্রাণ ও জৌলুস অনেকটাই কমে গেছে। আজেবাজে লোকেরা সুযোগ পেলেই অশ্লীল নাচ-গান, জুয়া, হাউজি ঢুকিয়ে দেয়। তবে এখন কিন্তু সরকার ও এনজিওগুলো বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক মেলার আয়োজন করে যেমন স্বাধীনতা মেলা, তথ্য অধিকার মেলা, আইটি মেলা, বাণিজ্য মেলা, মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা। এখন এসব নিয়েই বাংলার মেলা।

আব্বার কাছে শুনেছি, সেই ব্রিটিশ আমলে তাদের গ্রামে বসুনিয়ার হাটে অনেক বড় মেলা বসতো মহররমে, ঈদে আর পূজায়। মেলায় সার্কাসের দল আসতো। ভালুক নাচও হতো। বাক্স ক্যামেরায় নাকি ছবিও দেখা যেতো। আব্বারা তাদের সবচেয়ে সুন্দর জামাটি গায়ে চাপিয়ে নানার সাথে মেলায় যেতো। লক্ষ্য ছিল গুলতি, লাটিম, মাটির খেলনা কেনা। আর গুড়ের জিলাপি, কদমা, বাতাসা, গজা, দই-চিড়া-কলা খাওয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল এই মেলায় যাওয়ার জন্য মুরুব্বীরা নাকি তাদের পকেটে দুই/এক পয়সা গুঁজে দিতেন। এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, যুগের পর যুগ ধরে চলছে বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য এই বাংলার মেলা।

 

ছবি: শাহানা হুদা

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram’s garment factories fear fallout from US tariffs

Owners of Chattogram-based readymade garment factories, many of which do business with buyers in the United States, are worried about a US tariff hike to 35 percent set to take effect on August 1.

12h ago