মুক্তচিন্তার পথ তৈরি করে নেওয়ার তাগিদ
তাদের প্রায় প্রত্যেকের বয়স ৮০ পেরিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপেই ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির মানস গঠনের ক্ষেত্রেও তাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তাদের একেকজনের কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু প্রত্যেকেই আজীবন মানুষের অধিকার রক্ষা এবং স্বাধীন চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসারে কাজ করে গেছেন। পরিণত হয়েছেন জাতির পথপ্রদর্শনকারী বিবেক হিসেবে।
এভাবে নিজস্ব কীর্তির মাধ্যমে তারা সমাজে ইতিবাচক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন। বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছেন মননশীল চিন্তাধারা তৈরির ক্ষেত্রেও, যা এখনো বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত পটভূমিকে ধারাবাহিকভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
গতকাল শনিবার রাজধানী র্যাডিসন ব্লু হোটেলে দ্য ডেইলি স্টারের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা রক্ষা ও প্রচারে নিরলস কাজ করা এই ১২ কীর্তিমানকে 'সেনটিনেল অব ফ্রিডম অব থট' সম্মাননা দেওয়া হয়।
প্রতিক্রিয়ায় সম্মাননাপ্রাপ্ত এই আলোর পথের দিশারীরা তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেউ কাউকে উপহার দেয় না। লড়াই ও চর্চার ভেতর দিয়েই এই অধিকার আদায় করে নিতে হয়।
একইসঙ্গে মর্যাদার প্রশ্নে নিজেদের সবার ওপরে রাখার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, সুচিন্তাকে কখনো ভেতরে রাখা যাবে না। বৃহত্তর সমাজের স্বার্থেই এর প্রকাশ জরুরি।
সম্মাননাপ্রাপ্ত এই ১২ কীর্তিমান হলেন (নামের ইংরেজি বানানের আদ্যক্ষর অনুসারে)- আলোকিত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক, লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, শিক্ষাবিদ-প্রাবন্ধিক ও সাম্যবাদী তাত্ত্বিক যতীন সরকার, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, লেখক-সমাজকর্মী নূরজাহান বোস, 'টোকাই' চরিত্রের স্রষ্টা চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ ও প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রেহমান সোবহান, শিক্ষাবিদ-লেখক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এবং শিক্ষাবিদ ও ভাষা আন্দোলনকর্মী শরিফা খাতুন।
মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা কেন জরুরি
অনুষ্ঠানের শুরুতে ডেইলি স্টারের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শিল্প উদ্যোক্তা আ. রউফ চৌধুরীর প্রয়াণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বক্তব্য দেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। তিনি তার বক্তব্যে গত ৩২ বছরে ডেইলি স্টারের পথচলায় সঙ্গী হওয়া সবাইকে ধন্যবাদ জানান। কথা বলেন চিন্তার স্বাধীনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পরিসর নিয়ে।
মাহফুজ আনামের ভাষ্য, সমাজের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে জিনিসটির সবচেয়ে বড় অবদান থাকে, তা হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা। এটাই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে তা আমাদের নিয়ে যাবে অন্ধকারের দিকে, পরাজয়ের দিকে।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক বলেন, 'আমরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সড়ক, সেতু, টানেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করছি। এর সবই প্রয়োজনীয় এবং আমরা এর জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু মেধা বিকাশের, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পরিকাঠামো কোথায়? মানসম্মত শিক্ষা, যোগ্য শিক্ষক, একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়? নতুন গবেষণায় অনুদান কোথায়? জ্ঞান সাধনায় জীবন উৎসর্গ করার প্রণোদনা কোথায়?'
জ্ঞানীদের সম্মান জানানোর সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, 'স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কীভাবে অসম্মান করা হয়, অপমান করা হয় সেই খবর প্রকাশ করতে করতে আমরা ক্লান্ত। যে শিক্ষার্থীদের তিনি পড়াবেন, তাদের সামনেই তাকে চূড়ান্ত অপমান করা হচ্ছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য না। এটা আমাদেরকে ২১ শতকের বিশ্বের দিকে নিয়ে যাবে না।'
এ পর্যায়ে ফেব্রুয়ারিতে মহান ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়েও কথা বলেন তিনি। বলেন, 'ভাষা আন্দোলনের এই মাসে আমি সেই গানের কথা স্মরণ করতে চাই, যে গান আমরা গেয়েছি ছাত্রজীবনে। "ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়"। ওরা আমার মুখের ভাষা কেন "কাইড়া নিতে' চেয়েছিল" ? যাতে আমরা আমাদের অনুভব, সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে না পারি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিবাদ যেন করতে না পারি। পাকিস্তানিরা এটাই করতে চেয়েছিল। তারা আমাদের "না" বলার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।'
বক্তব্যে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ হাজির করে তিনি বলেন, 'আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, পাকিস্তানিরা চলে গেছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে বলছি, আজও আমাদের শিকল পরানো হচ্ছে। নিজের অজান্তেই আজ আমরা জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা বিসর্জন দিচ্ছি। আমাদের সমাজে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা কমে আসছে।'
খবরের উৎস যারা, তারাও সঙ্গী আনন্দ আয়োজনে
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শুরু হওয়া এই আনন্দ আয়োজনে ডেইলি স্টারের কর্মীদের পাশাপাশি যাদের নিয়ে খবর তৈরি হয়, যারা হন খবরের উৎস, তারাও সঙ্গী হন।
অনুষ্ঠান শুরু হয় সলিল চৌধুরীর 'আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন' শীর্ষক গান পরিবেশনার ভেতর দিয়ে। এর আগ থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্তিতস্কি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান প্রমুখ।
এছাড়া হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি এম আর হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ, অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান এতে উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শমসের মবিন চৌধুরী, শহিদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জহির উদ্দিন স্বপন প্রমুখ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
আরও ছিলেন যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, বিপাশা আইচ, সাহিত্যিক আনিসুল হক, চিত্রপরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী, রেদওয়ান রনি, শিহাব শাহীন ও রায়হান রাফি, অভিনেতা তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, আরিক আনাম খান, শাহনাজ খুশী, বৃন্দাবন দাস, সোহানা সাবা, আরিফিন শুভ, বুবলি, নিপুণ, সাইমন সাদিক, সোহেল মণ্ডল, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, পলাশ, বাঁধন, ভাবনা, শবনম ফারিয়া, জয়া আহসান, দীঘি, পরীমনি, রাজ, অনিমেষ আইচ, তানজিন তিশা, সারা যাকের, ইরেশ যাকের ও ফাহমিদা নবী।
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সাংবাদিক সাবির মুস্তাফা।
ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও নোয়াব প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী, ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী রেজা ইফতেখার, বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম
মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব নিয়ে সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের বক্তব্য আগেই ভিডিও করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে সেই ভিডিওগুলো দেখানো হয়।
সম্মাননা অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা দেন ডেইলি স্টারের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান রোকিয়া আফজাল রহমান।
সম্মাননাপ্রাপ্তদের হাতে ক্রেস্ট ও প্রতিকৃতি তুলে দেন ট্রান্সকম গ্রুপের গ্রুপ সিইও এবং মিডিয়া ওয়ার্ল্ডের বোর্ড মেম্বার সিমিন রহমান ও মাহফুজ আনাম।
সংগীতশিল্পী ও সাংবাদিক এলিটা করিমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক।
Comments