অসুস্থ মানসিকতার গেম ব্লু হোয়েল
গত কয়েক বছর থেকেই বিশ্বজুড়ে শতাধিক তরুণের আত্মহত্যার জন্য ব্লু হোয়েল নামের একটি অনলাইন গেমকে দায়ী করা হচ্ছে। ধারণা করা হয় প্রতিবেশী ভারতেও বেশ কয়েকজন তরুণের প্রাণ গেছে এই গেমে খলতে গিয়ে। এখন এই মারণ খেলা থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশেও। আর এর সবই ঘটছে অভিভাবকদের অজান্তে।
মনে করা হয় ২০১৩ সালে রাশিয়ায় ব্লু হোয়েল গেম প্রথম তৈরি করা হয়। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব থাকলেও ধারণা করা হয় অনলাইন দুনিয়ার সবচেয়ে বিতর্কিত এই গেম খেলতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ১৩০ জনের প্রাণ গেছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
গেমটিতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন একটি করে চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে বলা হয়। গেমটিতে প্রথম দিকে খুব সাধারণ কিছু চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয় যেমন ভোর সাড়ে ৪টায় একা একা ভুতের সিনেমা দেখতে বলা হতে পারে। পরের ধাপগুলোতে কোনো প্রাণীকে হত্যা বা নিজের অঙ্গচ্ছেদ এমনকি ড্রাগ নিতে বলা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে ক্রমেই কঠিন কঠিন চ্যালেঞ্জ দেওয়া হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে ৫০তম চ্যালেঞ্জ শেষ হয়।
গেমটি শেষ পর্যন্ত খেলার জন্য নানাভাবে চাপের মুখে রাখা হয়। এর ফলে অনেকেই এ থেকে আর বের হয়ে আসতে পারে না। শেষ ধাপে থাকে বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা। খেলা থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাবা-মাকে হত্যা করা হবে এমন হুমকিও দেওয়া হয়।
এই গেম খেলতে গিয়ে যেসব দেশের তরুণদের আত্মহত্যার কথা খবরে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, চিলি, চীন, ভারত, ইতালি, কেনিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, সৌদি আরব, সার্বিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও উরুগুয়ে। আর ভারতে এই গেমের উৎপাত এমন পর্যায়ে পৌছায় যে শেষ রাশিয়ার ভাইস কনসাল মিখায়েল যে গবার্তভ এই মারণ নেশা থামাতে হাইকোর্ট ও তামিলনাড়ু সরকারকে রুশ সরকারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেন।
ধারণা করা হয় ২১ বছরের ফিলিপ বুডিকিন নামের মনোবিজ্ঞানের বহিষ্কৃত এক ছাত্র প্রথম গেমের চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি করেন। ১৬ জন স্কুলছাত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। রাশিয়ার কারাগারে এখন তাকে রাখা হয়েছে।
ডেইলি মেইল ব্লু হোয়েলের নির্মাতার মনোভাব তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বুডিকিন মনে করেন যারা তার গেমের বলি হয়েছে তারা সমাজের আবর্জনা। পুলিশকে তিনি বলেন, যারা মারা গেছে তারা তা নিজ ইচ্ছাতে এবং খুশি মন নিয়েই করেছে। সমাজের আবর্জনা পরিষ্কার করছেন এমনটাই তার বিশ্বাস।
ব্লু হোয়েল গেমের ২৯তম চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত পার করেছেন এমন একজনের সাথে কথা বলতে পেরেছে দ্য ডেইলি স্টার।
পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওয়েবসাইট থেকে তিনি গেমটি ডাউনলোডের লিংক পেয়েছিলেন। আর ফেসবুকে ‘সাইবার ৭১’ নামের একটি ক্লোজড গ্রুপ থেকে তিনি খেলার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারেন।
গেমটি প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরে পাওয়া যায় না। এর ফলে তাকে নিজের অ্যান্ড্রয়েড চালিত মোবাইলে গেমটি সাইডলোড করে ইনস্টল করতে হয়েছিল। গেমের কিউরেটর প্রতিদিন তাকে নানা রকম ভয়ানক ভিডিও দেখার জন্য পাঠাতেন।
গেমের এই লেভেলগুলো পার হওয়ার সাথে সাথে তাকে হাত কেটে নির্দিষ্ট কিছু ছবি আঁকতে, ভোরে ছাদে হাঁটতে ও সূচ দিয়ে হাত ফুটো করতে বলা হয়। আর লক্ষ্য পূরণের প্রমাণ হিসেবে তাকে গেমের কিউরেটরকে ছবি তুলে পাঠাতে বলা হত।
ওই তরুণ বলেন, ময়মনসিংহে তারই এক ব্লু হোয়েল আসক্ত বন্ধু আত্মহত্যা চেষ্টা করার পর তিনি গেমটি থেকে সরে আসেন। ততদিনে তিনিও গেমের ২৯তম লেভেলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শেষ লেভেলে গিয়ে গেমের কিউরেটর তার বন্ধুকে আত্মহত্যা করতে বলেছিল এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
তার কথায়, “খেলা বন্ধ করার ব্যাপারে আমাকে ভয় দেখানো হয়েছিল। তারা বলেছিল আমি যদি গেম থেকে বের হয়ে আসি তাহলে তারা আমার বাবা-মাকে হত্যা করবে।”
বাংলাদেশে ব্লু হোয়েল ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে বিটিআরসি। তারা জানায়, ব্লু হোয়েল গেমের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো লিংক পাওয়া মাত্র তারা তা বন্ধ করে দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সোমবার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
আর অনলাইন গেমে তরুণদের আসক্তির জন্য সন্তানের প্রতি মা-বাবার সময় না দেওয়াকে মূলত দায়ী করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। খেলার মাঠ কমে যাওয়াকেও এর জন্য দুষছেন তারা।
Comments