আমার লেখালেখির গুণটি জন্মসূত্রে পাওয়া

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে  পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশ হয়েছে গবেষক ও কথাশিল্পি ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর 'জীবনানন্দ পত্রাবলি'। তিনি জীবনানন্দ  ও নিজের গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
 
দ্য ডেইলি স্টার: জীবনানন্দ পত্রাবলীতে তার কবি সত্তার বাইরে ব্যক্তিজীবন কতটা এসেছে বলে মনে করেন?

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: জীবনানন্দের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি—কারণ তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে লেখালেখির পরিমাণ খুব কম। তার মৃত্যুর পর লেখা গোটা কুড়ি স্মৃতিচারণ আমরা পেয়েছি—এর বেশী নয়। তিনি একটি আত্মজীবনী লেখার কথা ভেবেছিলেন। সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। তিনি চিঠি লিখে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভালোবাসতেন, অনুমান করি অন্তত ১ হাজার চিঠি লিখেছেন। তার থেকে মাত্র ১৩৭টি আমরা উদ্ধার করে গ্রন্থভুক্ত করতে পেরেছি। 

এই চিঠিগুলি গুরুত্বপূর্ণ কেননা, এ সব থেকে তার ব্যক্তিজীবনের কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্য, যেমন তাঁর ধর্ম বিশ্বাস, ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে নির্মম দৃষ্টিভঙ্গি, দারিদ্রের লাঞ্চনার কথা পাওয়া যায়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগ, নিজের কাব্যকৃতি, রচনা পদ্ধতি, বানানরীতি ইত্যাদি সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি। তবে তার প্রেম-ভালোবাসা-যৌনতাসহ ব্যক্তিগত অভ্যাস ও চিন্তাভাবনার কথা ৫৭টি দিনলিপিতে লিখে গেছেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই না করে দিনলিপিকে বেদবাক্য গণ্য করা ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, দিনলিপিতে দেখা যায় ১৫ অক্টোবর ১৯৫৪ তারিখেও তিনি লিখছেন। আগের দিন ট্রামের আঘাতে আহত হয়ে তিনি শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে অচেতন হয়ে শুয়ে ছিলেন ১৫ই অক্টোবরে। 

চিঠির পাশাপাশি চিঠির খসড়া, ফোটো, কবিতা ও অন্যান্য সংকলন করেছেন, এ কঠিক কাজ। কতদিন ধরে করছেন?

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: চাকুরীবিহীন অবস্থায় ২০১৩-তে কলকাতায় গেলে ভারতের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে সংরক্ষিত জীবনানন্দের কবিতা ও উপন্যাস লেখার খাতার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। ২০১৪ এবং ২০১৫-তে সেগুলোর অনুলিপি সংগ্রহ করি। তবে আমার জীবনানন্দ চর্চার শুরু ১৯৮৯-তে যে বছর আমি জীবনানন্দের কবিতার কথা এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো গ্রন্থিত করি। এক যুগ পর প্রকাশ করি জীবনানন্দের সকল প্রবন্ধের (খসড়াসহ) একটি সংকলন। 

১৯৯৪ এবং ২০০৬ সালে তার কবিতার অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করি। এ ছাড়া তার রচনা ও জীবনের নানা দিক নিয়ে অনেক  গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অনেক হারিয়ে যাওয়া বা স্বল্প পঠিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের কয়েকটি সংকলন প্রকাশ করেছি। সিগনেট প্রেস ১৯৫৭ সালে প্রথম 'রূপসী বাংলা' প্রকাশ করে। তার নির্ভুল একটি সংস্করণ কয়েক বছর আগে প্রকাশ করেছি। অন্যান্য কাব্যের নির্ভরযোগ্য পাঠ তৈরি করছি। ৭৫টি কবিতার পাণ্ডুলিপি সংস্করণ বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। 

কবি জীবনানন্দ ও  মানুষ জীবনানন্দ'র মাঝে কতটা ব্যবধান দেখেন আপনি?

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: কোনো মানুষই একজন মানুষ মাত্র নয়। একজন মানুষের ভেতর অনেক কয়টি মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও কবি বুদ্ধদেব বসুকে শ্রদ্ধা করতেন জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু 'সফলতা- নিষ্ফলতা' উপন্যাসের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে বুদ্ধদেব বাবুর জীবনাচরণ নিয়ে তার ক্রিটিক্যাল পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, তিনি নির্জনতা প্রিয়, একা থাকতে ভালোবাসেন—এসব তথ্যও সঠিন নয়। তিনি উপযুক্ত সঙ্গীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন। কফি হাউজে বহুবার গেছেন। মজার কথায় হো হো করে হাসতেন। সংসারের ব্যাপারে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি তার ছিল গাঢ় মমতা। লাবণ্য দাশের অসুস্থতার কারণে ভরা দারিদ্র্যের মাঝেও কলেজের চাকুরী ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। —কবি জীবনানন্দ দাশের দেখার শক্তি ছিল অনন্য সাধারণ। তিনি যখন কবিতা লিখতেন তখন অন্য এক জগতে চলে যেতেন যেখানে অসংখ্য শব্দ, শব্দবন্ধ, উপমা, বিকল্প আর প্রতীকের ছড়াছড়ি। এ রকম জগতের অধীশ্বর আর কোনো কবি কি এসেছেন এই পৃথিবীতে? ... কোনো  ঘটনার সঙ্গে কোনো অনুভূতির, কোন অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোন ভাবনার তিনি সংযোগ ঘটাবেন তা অনুমান করা অসম্ভব। কবি জীবনানন্দ যেন এ ঐহিক জগতের কেউ নন। নক্ষত্রবাসী। 

সাহিত্যে খুব সিরিয়াস বিষয়ে কাজ করছেন। বিশেষ করে আপনার গবেষণা পদ্ধতি জানাবেন? 

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: আমার গবেষণা পদ্ধতি হচ্ছে যাকে বলা যায় বর্ণনামূলক বিশ্লেষণ। তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই এর প্রথম ধাপ। তারপর তা লিখে ফেলা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি থিসিস বা থিওরী নিয়ে কাজ করি—এবং তা সত্য বা ভুল প্রতিপন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে করতে হয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমি পরিসংখ্যান সফটওয়্যার ঝচঝঝ ব্যবহার করি। 

একবার বলেছিলেন পাঠক থেকে লেখক আপনি। আপনার মাও একজন লেখক। আপনার জীবনে মায়ের ভূমিকা বা প্রভাব কেমন ছিলো?

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: আমার বাবা-মা দু'জনেই পঠন ও লেখালেখির বিষয়ে অঢেল স্বাধীনতা ও অবকাশ দিয়েছেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার মা শিক্ষিকা ছিলেন, পত্রিকায় মহিলাদের পাতা সম্পাদনা করেছেন। মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসায় করেছেন। 'দ্বিতীয় চিন্তা' নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছেন দীর্ঘকাল। এসব গৌরবজনক তথ্য। তিনি গল্প লিখেছেন—প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। স্বীকার্য আমার লেখালেখির গুণটি জন্মসূত্রে পাওয়া। 

Comments

The Daily Star  | English

No sharp rise in crime, data shows stability: govt

The interim government today said that available data does not fully support claims of a sharp rise in crimes across Bangladesh this year

1h ago