জসীম উদ্‌দীনের প্রেম-প্রণয়ের স্মৃতি 

মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ প্রেম, ভালোবাসা। প্রাচীন কাল থেকেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি— মানব-মানবীর ভালোবাসা নিয়ে সাহিত্যিকরা নিজনিজ আঙিনায় কাজ করেছেন। লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, শিরি-ফরহাদ প্রমুখ যুগলের কিংবদন্তির সাথে আমরা পরিচিত। 

মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ প্রেম, ভালোবাসা। প্রাচীন কাল থেকেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি— মানব-মানবীর ভালোবাসা নিয়ে সাহিত্যিকরা নিজনিজ আঙিনায় কাজ করেছেন। লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, শিরি-ফরহাদ প্রমুখ যুগলের কিংবদন্তির সাথে আমরা পরিচিত। 

আধুনিক যুগেও সাহিত্যিকরা‌ সমাজের এই প্রধান এক অনুষঙ্গ— ভালোবাসার সম্পর্ক এবং তার ঢালপালাকে তাদের সাহিত্যে মেলে ধরেছেন। কিন্তু সাহিত্যিকরা কেবল সমাজ থেকেই ভালোবাসার সম্পর্কের উপাদান কুড়িয়ে নেন না, অনেক সময় তাদের নিজের জীবনে ঘটা ঘটনা নিয়েই সাজান সাহিত্যের পসরা। তার মধ্যে জসীম উদ্‌দীন একজন। 

বাংলা কবিতার মূল সভায় চিরায়ত বাংলাকে নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্‌দীনের। তার নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শন। তবে তার প্রেম ভালোবাসার স্মৃতি কম মানুষ ই জানেন। তাই ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে তার স্মৃতিকথা থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো।

তখন আমি 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' পুস্তক রচনা করিতেছিলাম। এই রচনার মধ্যে আমি এই মণি-মাণিক্যগুলি কুড়াইয়া আনিয়া সেই বিলম্বিত কাহিনীটিকে নানা নকশায় ভরিয়া তুলিতে লাগিলাম। 

এই সুদীর্ঘ বই লিখিতে যখনই শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি তখনই আমি বড়ুদের বাড়ি যাইতাম, কোনােদিন হয়তাে লাল, সাদা, নীল নানারকমের সুতার নাছি নাটায়ের সঙ্গে ফেলিয়া বড়ু দুই পা মেলিয়া বসিয়া চরকা ঘুরাইয়া নলি ভরিত। বাম হাতে নাটায়ের সুতা ধরিয়া ডান হাতে চরকা ঘুরাইত। নাটাই ঘুরিয়া ঘুরিয়া তার হাতের মধ্যে সুতা ছাড়িয়া দিত। চরকার ঘুরনে সেই সুতা যাইয়া নলির গায়ে জড়াইত। কোনাে সুতা ছিড়িয়া গেলে সে কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া সুতাকে শাসাইত। তারপর চরকা থামাইয়া দুইহাতে সেই সুতাটি জোড়া দিয়া আবার চরকা ঘুরাইত। মাঝে মাঝে গুনগুন করিয়া গান গাহিত। আমার মনে হইত, যে-রূপ তাহার অঙ্গে ধরে না তাহাই যেন সে সুতায় ধরিয়া নলির মধ্যে জড়াইয়া লইতেছে। তাহার স্বামী কাল তাহাই রঙিন শাড়ির নকশায় মেলিয়া ধরিবে। আমি একান্তে বসিয়া এই দৃশ্য উপভােগ করিতাম। কোনাে কোনােদিন সে উঠানের মাঝখানে ছােট ছােট কাঠি গাড়িয়া তাহার উপর তেনা কাড়াইত। 

বাম হাতে নাটাই লইয়া ডান হাতে আর একটি কাঠির আগায় নাটায়ের সুতা আটকাইয়া সারা উঠান হাঁটিয়া হাঁটিয়া কাঠিগুলির সঙ্গে সুতা জড়াইয়া দিত। কখনও সাদা, কখনও নীল, কখনও হলদে আবার কখনও লাল। লালে-নীলে-সাদায়-হলুদে মিলিয়া সুতাগুলি যেন তারই গায়ের বর্ণের সঙ্গে আড়াআড়ি করিয়া সেই তেনার গায়ে যাইয়া জড়াইয়া পড়িত। তাহাদের বাড়ির উঠানে একটি প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছ। চারিধারে বড় বড় আমগাছ আর নানা-রকম আগাছার জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কানাকুয়া কুব কুব করিয়া ডাকিত। 'বউ কথা কও' পাখি ডাকিত। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক আসিয়া তাহাদের টিনের ঘরের চালায় বসিত। সমস্ত মিলিয়া যে অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হইত, আমি অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতাম আর মেয়েটির মতােই কল্পনার সূত্র লইয়া মনে মনে জাল বুনিতাম। 

মেয়েটি আমাকে দেখিতে পাইয়া তার তেনা কাড়ানাে রাখিয়া হাসিয়া বলিত, "ভাই! কখন আসিলেন?" তাড়াতাড়ি সে ঘর হইতে একখানা পিড়ি আনিয়া আঁচল দিয়া মুছিয়া আমাকে বসিতে দিত। তারপর আবার সে তাহার কাজে মনােনিবেশ করিত। আমি বসিয়া বসিয়া তাহার তেনা কাড়ানাে দেখিতাম। সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তেনা কাড়াইতে কাড়াইতে আমার সঙ্গে‌ গল্প করিত। কোনাে কোনােদিন আসিয়া দেখিতাম, সে উঠানের এক কোণে রান্না করিতেছে। আমি অদূরে পিঁড়ি পাতিয়া বসিতাম। উনানে দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিতেছে। সেই আগুনের তাপে তার মুখে ফোঁটায় ফোঁটায় মুক্তাবিন্দুর মতাে ঘাম শােভা পাইতেছে। ডালের ঘুটনি দুই হাতে ঘুরাইয়া সে যখন ডাল খুঁটিত তার হাতের কাচের চুড়িগুলি টুন টুন করিয়া বাজিত। 

উনানের আগুন কমিয়া গেলে সে তাহাতে আরও লাকড়ি পুরিয়া দিত। আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিত। সেই আগুন যেন আমার ভিতরেও জ্বলিয়া উঠিত। শাক রাধিবার সময় সেই শাকপাতার গন্ধে সারা বাড়ি আমােদিত হইয়া উঠিত। সেই শাকে ফোড়ং দেওয়ার‌ সময় সে উত্তপ্ত তৈলের মধ্যে আধসিদ্ধ শাকগুলি ছাড়িয়া দিয়া সেই বনের পাতাগুলিকে সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত করিত। কিইবা তাহার সংসার! একখানা মাত্র ছােট ঘর। বাপ তাহাকে উঠানের ও-ধারের ঘরে থাকিতে দিয়াছে। সেখানে কয়েকটি মাটির হাঁড়ি-পাতিল। কতই না যত্নে সেই ঘরখানিকে সে লেপিয়া-পুঁছিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখে। সেই হাঁড়ি-পাতিলগুলিকে সে ধুইয়া মুছিয়া কত যত্ন করিয়া যেটা যেখানে শােভা পায় সেখানে সাজায়। মাটির শানকিখানি, তার উপরেও তার যত্নের পরিসীমা নাই। মনে বলে, আমি যদি ওর ঘরের কোনাে একটা জিনিসে পরিণত হইতে পারিতাম—ও আমাকে এমনি করিয়া যত্ন করিত। শুধুই মনে মনে ভাবি। মনের কথা প্রকাশ করিয়া বলিবার সুযােগ পাই না। আমি আসিলে দাদি আসিয়া সামনে বসেন। চাচি আসিয়া সামনে বসেন। কতরকমের কথা হয়। কিন্তু যেকথা বলিতে ইচ্ছা করি, সেকথা বলিতে পারি না।

সেদিন আরও দুই-তিনটি গান হইল। একটি গানের প্রথম পদটি মনে আছে:

"আরে শ্যাম, গাঙে আইলরে নতুন পানি।"

এরপর প্রায়ই আমি বড়ুদের বাড়ি যাইতাম। মনে মনে কত কথা তাহাকে বলিব বলিয়া কল্পনা করিয়া যাইতাম। কিন্তু ছােট তাহাদের বাড়ি। ও-ঘরে চাচি, ওখানে দাদি। আজেবাজে গল্প করিয়া চলিয়া আসিতাম। মনের কথা মনেই থাকিত। বাড়ি আসিয়া ভাবিতাম, কি কথাই-বা তাহাকে বলিতে পারিতাম। সে অপরের স্ত্রী। তাকে একান্তে বলিবার মতাে কোনাে কথাই তাে আমার ছিল না। আমি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ি। ছুটি ফুরাইয়া গেলে কলিকাতা চলিয়া যাইতাম।

পূজার ছুটিতে আবার দেশে আসিয়া বড়ুদের বাড়ি আসিতাম। এবার বড়ুর চেহারাটি আরও সুন্দর হইয়াছে। কত দেশে সুন্দর কন্যার কাহিনী খুঁজিয়া বেড়াই। আমার দেশে আমারই গাঁয়ে এমন সুন্দর কন্যা! এই চাঁদ আমারই আঙিনায় আসিয়া খেলা করিয়াছিল। তখন হাত বাড়াইলেই ধরিতে পারিতাম। আজকের চাঁদ যে কত দূরের আকাশে। কোনােরকমেই তাকে হাতে নাগাল পাইতে পারি না। একদিন বড়ুকে একান্তে পাইয়া বলিলাম, "বড়ু, আগে যদি জানিতাম তােকে আমার এত ভাল লাগিবে, তবে কি তােরে অপরের ঘরনী হইতে দিতাম?" বড়ু ম্লান হাসিয়া বলিল, "ভাই! ওকথা বলিবেন না। উহাতে গুনা হয়।"

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshi students terrified over attack on foreigners in Kyrgyzstan

Mobs attacked medical students, including Bangladeshis and Indians, in Kyrgyzstani capital Bishkek on Friday and now they are staying indoors fearing further attacks

6h ago