দুরন্ত সাইকেলে দুর্গতিনাশিনী

Jahiron
গত ৪৪ বছর থেকে “বাংলার নানী”-খ্যাত ৯০ বছর বয়সী এই বিধবা নারী জহিরন বেওয়া অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদেরকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশ দিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: স্টার

আপনি যদি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় যান সেখানে একজন বয়স্ক নারীকে দেখতে পাবেন। হাসিমুখে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মহীয়সী নারী বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই সেবা দিয়ে থাকেন।

গত ৪৪ বছর থেকে “বাংলার নানী”-খ্যাত ৯০ বছর বয়সী এই বিধবা নারী অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদেরকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশ দিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন।

আদিতমারীর ভেলাবারি ইউনিয়নের তালুক দুলালী গ্রামের মৃত সৈয়দ আলীর স্ত্রী জহিরন বেওয়া বলেন, “আমি লোকজনকে সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেই। জটিল রোগের জন্যে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেই। কখনো কখনো তাঁদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করি।”

জহিরন ১৯৭৩ সালে স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনার ওপর একটি ছয়মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স করেছিলেন। এরপর থেকেই তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, “আমি রোগীদের বাড়ি বাড়ি যেতাম। সেই অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারিনি।”

হাজীগঞ্জ গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, “গত কয়েক দশক থেকে আমি তাঁকে (জহিরন) দেখছি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে এই এলাকায় মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য তিনি কোনো টাকা নেন না। ওষুধ দিলে তাও আবার বাজারে যে দাম সেই দামেই দেন। আবার গ্রামের গরীব লোকদের কাছ থেকে ওষুধের টাকাটাও নেন না।”

চন্দনপট গ্রামের ৬৭ বছর বয়সী মনোয়ারা বেওয়া বলেন, “জহিরন কোন ডাক্তার না। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক। তাঁর পরামর্শ নিয়ে আমরা সাধারণ রোগ থেকে মুক্তি পাই।”

Jahiron-3
জহিরন কোন ডাক্তার নন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক। তাঁর পরামর্শ নিয়ে লোকজন সাধারণ রোগ থেকে মুক্তি পান। ছবি: স্টার

দুলালী গ্রামের ৪২ বছর বয়সী সন্তানসম্ভবা নারী খাদিজা বেগমের মুখেও শোনা গেল জহিরনের প্রশংসা। “গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে তিনি তাঁদের কাছ থেকে কখনই কোনো টাকা নেন না। এছাড়াও, ধাত্রীর কাজে তিনি এই এলাকায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ।”

পিতৃভূমি টাঙ্গাইলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাওয়া জহিরন বলেন, তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে আটটি গ্রামে ৬০টি বাড়িতে যান। “প্রতি মাসে আমি ৩০টি গ্রামে যেতে পারি। আর ওষুধ বিক্রি করে দিনে ১৫০ টাকা আয় করি।”

জহিরনের নাতি ৪৯ বছর বয়সী সিদ্দিক আলী কিছুটা উদ্বিগ্ন থাকেন এ কারণে যে এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি (জহিরন) প্রতিদিন সকালে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যান। সিদ্দিক বলেন, “তবে এখনো নানীর একটি দাঁতও পড়েনি। শারীরিকভাবে তিনি বেশ বলিষ্ঠ। তবে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো তাঁর হাসিমাখা মুখখানি।”

এই হাসিমাখা মুখ নিয়েই জহিরন বলেন, “গত ৫০ বছর ধরে কোনো রোগ-বালাইয়ে পড়ি নাই।”

জহিরনের ছোট ছেলে ৫৮ বছর বয়সী তোরাব আলী জানান যে তাঁদের যৎসামান্য ফসলী জমি রয়েছে তাই তেমন কোনো আর্থিক কষ্ট নেই। মায়ের কাজ করারও প্রয়োজন হয় না।

তোরাব আলী বলেন, “মাকে অনেকবার বলেছি কাজ করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি তা শোনেন না। তিনি (জহিরন) বলেন যে তাঁর কাজতো শুধুমাত্র তাঁর নিজের জন্যে নয়। তিনি বলেন এটা সমাজের জন্যে, সবারই উচিত সমাজের সেবা করা।”

তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মা জহিরন। তাঁর বড় ছেলে দানেশ আলী আট বছর আগে মারা যান ৬৬ বছর বয়সে এবং ছয় বছর আগে তিনি তাঁর স্বামীকে হারান। একটি সাধারণ সাইকেলের মতোই সাধারণ তাঁর স্বপ্নগুলো। আর সেটি হচ্ছে শেষ নিশ্বাস নেওয়ার আগ পর্যন্ত আদিতমারীর গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Israel army says missiles fired from Iran; explosions heard in Tel Aviv

Trump brokered ceasefire agreement in contact with Israel, Iran: White House official

2d ago