৯৬তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

পথের পাঁচালীতে সত্যজিৎ

ইতালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরি দ্য সিকার বানানো নিও রিয়েলস্টিক ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ (ইংরেজিতে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’) ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন এক বাঙালি তরুণ। সিনেমার মধ্যে খুঁজেছিলেন জীবনের অস্তিত্বকে। একসময় রবীন্দ্র সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। তিনি সত্যজিৎ রায়।

ইতালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরি দ্য সিকার বানানো নিও রিয়েলস্টিক ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইংরেজিতে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’) ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন এক বাঙালি তরুণ। সিনেমার মধ্যে খুঁজেছিলেন জীবনের অস্তিত্বকে। একসময় রবীন্দ্র সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। তিনি সত্যজিৎ রায়।

সত্যজিৎ একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, লন্ডনে ঐ ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি চলচ্চিত্রকার হবেন এবং প্রথম চলচ্চিত্রটি তৈরি করবেন কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে। তারপর সমস্ত আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সিনেমাতে।

যে পথের পাঁচালী ছবি বানিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে নিজের স্থান করে নেন, সেই পথের পাঁচালীর কাহিনিটা নাটকীয়ভাবেই এসেছিল তাঁর জীবনে। সত্যজিৎ যে প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করতেন, সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় বইগুলো একেবারে সাধারণ পাঠক বা কিশোরদের উপযোগী করে নতুন সংস্করণে ছাপা হতো। আর সেইসব বইগুলির প্রচ্ছদসহ আরও অন্য ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়তো সত্যজিৎ রায়ের ওপর।

একদিন সিগনেট প্রেসের প্রধান ডি কে গুপ্ত সত্যজিতকে ডেকে বললেন, পথের পাঁচালীর কিশোরপাঠ্য সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বের হবে এবং প্রচ্ছদসহ –এর ভেতরের ছবিগুলো তাঁকে আঁকতে হবে। ঘটনাটি ১৯৪৫ সালের। সত্যজিৎ তখনও পথের পাঁচালী পড়েননি। ব্যপারটি শুনে ডি কে গুপ্ত তাঁকে জানিয়ে দিলেন, এই বইয়ের কাহিনি থেকে একটি সুন্দর চলচ্চিত্র হতে পারে। তারপর সত্যজিৎ তিনশ’ পৃষ্ঠার মূল বই পড়ে ফেললেন। পড়ে শুধু তিনি অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপূর্ব’! তারপরই কাহিনিটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও মনের ভিতর গেঁথে যাওয়া প্রখ্যাত কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি নিয়ে ভাবনার কমতি ছিল না তাঁর। অবশেষে মনস্থির করলেন সিনেমা বানাবেন বলে। যদিও পথের পাঁচালী -এর চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক তোড়জোড় হয়েছিল! স্ক্রিপ্টটি নিতে আগ্রহী ছিলেন আরও অনেকে। কিন্তু, বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা দেবী সত্যজিতকেই দিয়েছিলেন পথের পাঁচালীর স্বত্ব। তারপর পথের পাঁচালী দিয়েই শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের পরিক্রমা। আর এই পথচলায় সূচনা হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের।

সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি প্রবল ভূমিকম্পের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের গৃহীত কাঠামোকে চূর্ণ করেছে। চলচ্চিত্রটির নব্য বাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচকদের হতবাক করেছিল। এই ছবিই একদিন সত্যজিৎ রায়কে পরিচিত করে তুললো বিশ্বব্যাপী।

পথের পাঁচালী সবদিক থেকেই উন্নতমানের চলচ্চিত্র। বিশেষ করে ছবির আঙ্গিক। তা না ছিল প্রথাগত হলিউড না ছিল ইটালিয়ান নিও রিয়ালিস্ট ঘরানা। একেবারেই অতুলনীয়। ছবির বিষয় নিয়ে অজস্র লেখা আছে। কিন্তু এই আঙ্গিক নির্মাণের কাজটা যে বেশ জটিল, সেটি স্বীকার করেছিলেন সত্যজিৎ। ‘কিন্তু এই জটিলতাসহ সাংগীতিক কাঠামোর সামগ্রিকতা যদি শিল্পীর অনুভবে না আসে, তা হলে ফিল্ম করা যায় না। আর সেই অনুভবকে উপলব্ধি করতে না পারলে ভাল ফিল্ম বোঝাও যায় না।’ অমোঘ মন্তব্য তাঁর। তাঁর মতে চলচ্চিত্র শিল্পের পথিকৃতেরা অনেকেই ছিলেন সংগীতরসিক। গ্রিফিথ বেটোফেনের সংগীত থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন এ কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। ‘বার্থ অব এ নেশন’ বা ‘ইনটলারেন্স’ ছবির দৃশ্যগঠনে এই সংগীতশৈলীর কাঠামো লক্ষ্য করার মতো

‘ভারতকোষ ৩য় খণ্ড’-এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘চিত্রনাট্য’ লেখাটি। যেখানে তিনি লিখেছেন, চলচ্চিত্রের রস মূলত তাহার চিত্রভাষায় নিহিত। সংগীতের মতোই চলচ্চিত্রের রস অন্য কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয় আর এই চিত্রভাষার উপলব্ধির প্রধান অন্তরায় আমরাই, ‘আমাদের বাঙালিদের, শিল্প গ্রহণের মনটা বোধহয় মূলত সাহিত্যিক মন। অর্থাৎ সাংগীতিক মন নয়, বা চিত্রগত মন নয়,উপলব্ধি করেছেন তিনি। এই প্রবন্ধেই সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নির্দিষ্ট করেছেন তাঁর মত, ‘সাহিত্যের ওপর ফিল্মের এই নির্ভরতাকে প্রায় অস্বীকার করেই ফিল্মের সাংগীতিক কাঠামোর জন্ম।’

‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন সামনে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেশে-বিদেশে সিনেমাবোদ্ধাদের আলোড়িত করেছিল। বহু নামীদামি পরিচালক এক নবীন নির্মাতার চলচ্চিত্র দেখে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন। অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। ‘পাত্তা না পাওয়া’ এক সিনেমা পাগল তরুণের দিকে দৃষ্টি পড়েছিল সবার। যে তরুণ নির্মাতা একটি স্বপ্ন পূরণের জন্য বিত্তবানদের কাছে ঘুরেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর দেখা গেলো তাঁর পিছনে ছুটেছে ভারতের সবচেয়ে নামীদামি প্রযোজক সংস্থাও। সিনেমা নির্মাণের জন্য পরবর্তীতে আর অর্থ কষ্টে পড়তে হয়নি। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎকে জানতে হলে তাঁর ভিতরের চিত্রকরটিকেও চিনতে হবে, আর সে জন্যই প্রাণের উৎসর্গ খুঁজতে হবে তাঁর চলচ্চিত্রে।

Comments

The Daily Star  | English
Rapidly falling groundwater level raises fear for freshwater crisis, land subsidence; geoscientists decry lack of scientific governance of water

Dhaka stares down the barrel of water

Once widely abundant, the freshwater for Dhaka dwellers continues to deplete at a dramatic rate and may disappear far below the ground.

11h ago