বাস্তব চরিত্র নিয়ে লেখার চেয়ে বানিয়ে গল্প বলা অনেক সহজ

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রথমা থেকে প্রকাশ হয়েছে' কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের রক্তে আঁকা ভোর'। নতুন বই ও নিজের লেখালেখি  নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রথমা থেকে প্রকাশ হয়েছে' কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের রক্তে আঁকা ভোর'।

নতুন বই ও নিজের লেখালেখি  নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: 'রক্তে আঁকা ভোর' আপনার একটি ধারাবাহিক চিন্তার শেষ পর্ব। কত দিনে শেষ করেছেন। লেখার প্রেক্ষাপট জানাবেন?

আনিসুল হক: রক্তে আঁকা ভোর একটা উপন্যাসধারার ৬ষ্ঠ পর্ব। যারা ভোর এনেছিল,  ঊষার দুয়ারে,  আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে এবং এখানে থেমো না--এই পাঁচটি উপন্যাসের পর 'রক্তে আঁকা ভোর'। যারা ভাের এনেছিল প্রথমে বেরুতে শুরু করেছিল ঈদসংখ্যায়, ২০১০ সালে। বই হয়ে বের হয় ২০১২ সালে। অর্থাৎ ১২ বছরের বেশি সময় ধরে আমি একটা ধারণা বা থিমের সঙ্গে বসবাস করছি। শেখ মুজিবের সঙ্গে বালিকা রেণুর বিয়ে দিয়ে এই কাহিনীর শুরু।

'এখানে থেমো না' শেষ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটা ওয়ারলেসে পাঠানোর ঘটনা এবং ৩২ নম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ঘটনা দিয়ে। 'রক্তে আঁকা ভোর' শুরু হয়েছে এরপর থেকে। মানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিবরণ দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ মানে কেবল যুদ্ধ নয়, এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রাম। কী করে শেখ মুজিব শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন, মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা থেকে শুরু করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রফিক, বরকত, শফি--এঁরাই বা কে ছিলেন, কী করলেন,  তার একটা ধারাবাহিক ছবি আমি গল্পের মধ্য দিয়ে আঁকতে চেয়েছি। এর মধ্যে ১৯৭১ পর্ব হলো রক্তে আঁকা ভোর। 

এরপর আমি ৬টা বই একত্রিত করব। অখণ্ড যারা ভোর এনেছিল বের করব। সেটার শেষে একটা উপসংহার দিতে হবে। এপিলগ। সেটা হবে ৩২ নম্বরের সরগরম বাড়িটা যে ফাঁকা হয়ে গেল, সেটার একটা সাহিত্যিক বিবরণ। তাতে ইতিহাসের চেয়েও বেশি থাকবে শিল্প-কল্পনা।

পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মতো বড়ো ট্রাজেডি তো আর কিছু নেই। সেই ট্রাজেডিটা লিখতে হবে। তবে তা আলাদা খণ্ড হিসেবে বের হবে না। ৬টা বই একসঙ্গে করলে দুই হাজার পৃষ্ঠার একটা বই হবে। তাতে আমরা, বাংলাদেশের লেখকেরা দীর্ঘ উপন্যাসও লিখতে পারি, তারও একটা সামান্য এবং বিনীত উদাহরণ পেশ করতে পারব। আর একজন লেখক প্রায় ১৩/১৪ বছর ধরে একটা উপন্যাস লিখছেন, সেখানে যে নিবেদনের ব্যাপারটা আছে, সেটাও হয়তো একেবারে ফেলনা কিছু নয়।

ডেইলি স্টার: ব্যক্তি, নির্দিষ্ট বিষয়ে বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন। এইরকম নির্দিষ্ট বিষয়ে লেখার চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা কী?

আনিসুল হক: আমি মা উপন্যাস লিখেছি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এটাও মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আজাদ আর আজাদের মা সত্যিকারের চরিত্র। এ-রকম আরো আরো উপন্যাস আমার আছে। বাস্তব চরিত্র নিয়ে কাল্পনিক উপন্যাস লেখার প্রধান অসুবিধা হলো, কল্পনার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়, ঐতিহাসিক সত্য রক্ষার দিকে নজরটা বেশি চলে যায়, অনেক সময় উপন্যাসের গল্প বলা বাদ দিয়ে সংবাদপত্র বা ইতিহাস বইয়ের মতো ঘটনার বিবরণ চলে আসতে থাকে কলমের ডগায়। সেটা খুবই অসুবিধা ঘটায়। লেখককে বেঁধে ফেলতে চায়। 

বাস্তব ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে লেখার চেয়ে বানিয়ে গল্প বলা অনেক বেশি সহজ।

ডেইলি স্টার: মা উপন্যাসের কথা প্রায় বলেন আপনি। এমন জীবন্ত চরিত্র মাথায় ঘুরলে, নতুন কিছু ভাবতে অসুবিধা হয় না?

আনিসুল হক: না। নতুন কিছু যখন লিখি, তখন তো নতুন কিছুতেই ডুবে যাই। আমি যখন ভাত খাই, তখন তো আমি ধরা যাক পান-সুপুরি খাই না। ভাতই খাই। আমি যখন কবিতা লিখি, তখন তো কলাম লিখি না। তেমনি বাস্তব চরিত্র নিয়ে একটা কাজ করছি, তখন ওই কাজেই ডুবে যাই। আবার কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে যখন লিখছি, তখন কল্পনার রাজ্যেই ডুবে থাকি।

ডেইলি স্টার: আমাদের সমাজে মানুষের রসবোধ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী, সম্প্রতি একটি পোস্ট নিয়ে চারদিকে খুব সমালোচনা হয়েছিল।

আনিসুল হক: মানুষের রসবোধ কম, আসলে তা মনে হয় না। এই দেশের মানুষ ভীষণ রসিক। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের সাইকোলজি মানুষের মনে কাজ করে। কেউ হয়তো ভাবল, আমি সাকিব আল হাসান বা তামিম ইকবালকে একটা বাজে কথা শোনালাম, তার দ্বারা আমি সাকিব বা তামিমের সমমর্যাদা অর্জন করলাম। আমাকে দুজন লেখক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার আর স্বকৃত নোমান বলেছেন, রসিকতা লোকে ঠিকই বোঝে, কিন্তু অনেকেই আমার বিরোধিতা করেছে ঈর্ষা থেকে। আমি হেসে বলেছি, আমার কী আছে যে আমাকে লোকে ঈর্ষা করবে।

এখন কারো বইয়ের বেশি দাম হলেই তিনি দামি লেখক হন না, এটা না বোঝার মতো আমি বোকা বা অহংকারী, এটা লোকে ভাবতে পারল কেন, আমি ভেবে পাই না। রবীন্দ্রনাথের বই ঝিনুক থেকে বের হতো খুব কম দামে। বুদ্ধদেব বসু এক পয়সায় কবিতা নামে কবিতার বইয়ের সিরিজ বের করেছিলেন, তাতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বইও ছিল, এক পয়সা দামের। তাতে কি তারা সস্তা লেখক হয়ে গেলেন? আর আমি বা পচা মিয়া একটা বই পাঁচ হাজার টাকা দাম রাখলেই আমি বা পচা মিয়া দামি লেখক হয়ে যাব না, এটা না বোঝার মতো বোকা বলে আমাকে আপনাদের মনে হয়!

আসল ঘটনাটা আমি খুলে বলি-

একবার এক তরুণ এসে বইমেলায় বলেছিলেন, আপনার বইয়ের দাম বেশি।

আমি রসিকতার ছলে বললাম, 'আমার বইয়ের দাম সব সময় বেশি, আমি সস্তা বই লিখি না।' বলে হাসলাম। আমার সামনে দাঁড়ানো তরুণটি কিন্তু হাসছেন না। তার মুখ গম্ভীর। মনোযোগ দিয়ে জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে গুনছেন তিনি। পাশে তার বান্ধবী। তরুণটি টাকার ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন, 'আপনার বইয়ের দাম দিলে আমাদের আর ফেরার টাকা থাকে না।'

আমি বললাম, 'আপনি ফেরার টাকা পকেটে রাখেন। আরও কয়েকটা টাকা ইমার্জেন্সির জন্য রাখতে হবে। এবার বলেন, আপনি কত টাকা দিতে পারবেন?'

আমার বইটার দাম তিন শ টাকা। কমিশন বাদ দিয়ে আসে ২২৫ টাকা। তরুণ বললেন, 'দেড় শ টাকা দিতে পারব।'

আমি বললাম, 'আপনি এক শ টাকা দ্যান। বাকি টাকা আমি আমার নামে লিখে রাখব। সৌজন্য সংখ্যার অনেক কপি আমি প্রকাশকের কাছ থেকে পাই। নেওয়া হয় না। একটা বইয়ের দাম কম নিলে প্রকাশকের এমন কোনো ক্ষতি হবে না।'

আমার বই কিনে নিয়ে কাগজের প্যাকেট থেকে বইটি বের করলেন তরুণ। বললেন, 'আপনি একটা অটোগ্রাফ দিন।'

আমি বললাম, 'আপনাকে দেব নাকি ওনাকে (তরুণের বান্ধবীকে) দেব? নামটা বলবেন?'

তরুণ বললেন, 'আমার মাকে দেবেন। আমার মা বইটা ধার নিয়ে পড়েছেন। আপনার বইটা তাঁর খুব প্রিয়। মা ক্যানসারের পেশেন্ট। ডাক্তার বলে রেখেছেন, আর বেশি দিন নেই। হার ডেজ আর নাম্বারড।'

আমি বললাম, 'আপনার নাম বলুন।'

'জোবায়ের।'

'আপনি মাকে মা বলে ডাকেন না আম্মা বলে?'

'মা।'

আমি লিখলাম, 'জোবায়েরের মাকে... জীবন জয়ী হবে।'

পরে তাঁর হাতে বইটা তুলে দিয়ে বললাম, 'সরি জোবায়ের। আপনার মায়ের জন্য আমার অনেক দোয়া থাকল।'

দেখুন, লোকে টিজার নিয়ে মেতে রইল। টিকটিকির লেজটার লাফানোই আমরা দেখলাম। টিকটিকিটা দেখলাম না।

ডেইলি স্টার: একজন লেখক বা পাঠক কতটা বাস্তবে কতটা স্বপ্নে বাস করেন?

আনিসুল হক: আমি স্বপ্নে থাকি না। আমি থাকি কল্পনায়। ভাবনার জগতে। আমি ভাবতে থাকি। ঘোরগ্রস্ত থাকি। সেটা স্বপ্ন নয়। সেটা হলো, আপন চিন্তার জগতে ডুব দেয়া। হয়তো আগামীকাল কোনো কাজ করব, সেটাই ভাবছি। নয় তো গতকালের কাজটা কেমন হলো তা নিয়ে ভাবছি। এই কাজগুলোর সবই  যে সৃষ্টিশীল কাজ, তা নয়। সাধারণ কাজ। সেটা চাল-ডাল কেনা থেকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়াও হতে পারে।

কাজেই আমি একই সঙ্গে বাস্তবের এবং ভাবনার জগতের মানুষ। অনেকটা  আলো একই সঙ্গে কণা একই সঙ্গে তরঙ্গের মতো। সেক্ষেত্রে আমি আদৌ আছি, নাকি আমি কারও কল্পনা-- তাও তো জানি না। আমি একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিংবা রিয়াল ভার্চুয়ালিটি।

Comments

The Daily Star  | English

Mercury hits 42.7°C in Chuadanga, season's highest

Chuadanga today recorded the highest temperature of this season at 42.7 degree Celsius

44m ago