‘ভেড়াই আমার সবকিছু’

সাভারের ফরিদা খাতুনের ভাগ্যটা এমন যে যখন তিনি দুই মাসের গর্ভবতী তখনই তাঁর স্বামী আতর মিয়া তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেন।

সেসব ১৯৮০ দশকের শুরুর কথা। পাথর সরিয়ে গোলাপ যেমন প্রস্ফুটিত হয়, তেমনি ফরিদা নিজেকে বিকশিত করলেন সমস্ত বাধা কাটিয়ে। শুধু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই নয়, সেই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার তীব্র বাসনা ফরিদাকে পথ দেখায় সুন্দর ভবিষ্যতের। সে সময় ৮০ টাকায় একটি ভেড়া কেনা হয় তাঁর জন্যে।

আজকের ৫০ বছর বয়সী ফরিদা খাতুনের ভাগ্য বদলানোর ইতিহাস বিশ্বাস করতে হয়তো অনেকেরই কষ্ট হবে। প্রথম দিকে, তিনি তাঁর মা-বাবার বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই তাঁর ছেলে বাবুল হোসেনের জন্ম হয়। ফরিদার মা-বাবা তাঁকে আবারও বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যান। তাঁরা ভেবেছিলেন এর মাধ্যমেই হয়তো তাঁদের মেয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। কিন্তু ফরিদা অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। বিশেষ করে, তাঁর ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি আর সে পথে পা বাড়াননি।

১৯৮৫ সালে ফরিদার ভাই আবুল হোসেন ৮০ টাকায় একটি ভেড়া কিনে তাঁকে দেন। সে সময় তিনি ভাবতেই পারেনি যে এই ভেড়াটিই একদিন তাঁর বোনকে একটি ভেড়ার খামারের গর্বিত মালিক বানিয়ে দিবে।

ফরিদা খাতুন বসবাস করেন সাভারের কুমারখোদা আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল তিনি তাঁর খামারে কাজ করছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে ৪৯টি ভেড়া। দ্য ডেইলি স্টারের এই সংবাদদাতাকে তিনি বলেন, “আমার স্বামী যখন আমাকে ছেড়ে চলে যান তখন আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। তখনো আমি আমার নিজের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমি যা পেয়েছিলাম তা হলো একটি ভেড়ার ছানা। তাই আমাকে সেটা দিয়েই শুরু করতে হয়েছিল।”

ফরিদার দৃঢ়তা ও ধৈর্যের গল্প যেন আরও বেশি আকর্ষণীয়। কোন আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই এবং মাত্র আড়াই শতকের এক টুকরো জমির ওপর ভিত্তি করে তিনি এখনও একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের ঘরের বারান্দায় তিনি বানিয়েছেন ভেড়ার খোঁয়াড়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভেড়াগুলো খোঁয়াড়ে ঢোকে আর ঘুমায় সকাল ১০টা পর্যন্ত। সবসময়ই ভেড়াগুলো থাকে ফরিদার চোখে চোখে।

ভেড়াগুলোকে প্রতিদিন সকালে তিনি মাঠে নিয়ে যান। আবার দুপুরে ফিরিয়ে আনেন। তাঁর ভাষায়, “এমনই করে ৩২টি বছর কেটে গেল।”

শাশুড়ির ধৈর্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফরিদার ছেলের বউ সেলিনা বেগম বলেন, “যদি কোনও ভেড়া মারা যায়, তাহলে তিনি (ফরিদা) শোকে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। এগুলো যেন তাঁর পরিবারেরই সদস্য। এমনকি, একটি ভেড়া বিক্রি করতেও তাঁর মন কষ্টে ভরে উঠে। আর ভেড়াগুলোও তাদের মালিকের কথা মেনে চলে। তিনি যেখানে যান, ভেড়াগুলোও তাঁর পিছু নেয়।”

সেলিনার মন্তব্য, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ফরিদা ভেড়া চরিয়ে যাবেন, কেননা, এগুলোই তাঁকে বেঁচে থাকার নতুন পথ দেখিয়েছে।

ফরিদার এই সাফল্য আজ তাঁর আশপাশের অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্প্রতি তাঁর এক প্রতিবেশী রাজিয়া বেগম তাঁরই কাছ থেকে ৬,০০০ টাকায় এক জোড়া ভেড়া কিনেছেন। রাজিয়া বলেন, “ফরিদার মতো আমিও আমার ভাগ্য বদলাতে চাই।”

আরেকজন প্রতিবেশী সালমা বেগমেরও ইচ্ছা ভেড়া পালনের। “অবসর সময় কাটনোর জন্য আমিও ফরিদার মতো ভেড়া পালতে চাই।”

ফরিদার ছেলের তিনটি সন্তান রয়েছে। তিনি ফুলের ব্যবসা করেন। তবুও পরিবারের সব খরচ এখনো ফরিদাই বহন করেন।

হাসি মুখে তিনি বলেন, “আমি আমার নাতি-নাতনিদের পড়ালেখার খরচ চালাই। এমনকি, আমার বৌমার গায়ের গয়নাও আমার কিনে দেওয়া।”

ফরিদার মুখের সেই হাসি খাঁটি সোনার চেয়েও দামি। এমন হাসির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। ফরিদা পেছনে তাকতে চান না, কেননা, তাঁর দৃষ্টি সামনের দিকে। মানুষের জীবন চিরদিন একই ভাবে যায় না। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তাই একটি ভেড়া ছানা থেকে আজ অনেকগুলো ভেড়া। ফরিদার ভাষায়, “ভেড়াই তো আমার সংসার, ভেড়াই তো আমার সবকিছু।”

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

India’s white-ball tour of Bangladesh deferred to September 2026

The Bangladesh Cricket Board (BCB) on Saturday confirmed that India’s white-ball tour of Bangladesh, originally scheduled for next month, has been postponed to September 2026.

2h ago