রাষ্ট্রকে চিনবার উপায়

রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে আইন, আছে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা। সমাজ যদি মানুষকে মানুষ করে না তোলে তবে সে অপরাধী, রাষ্ট্রও অপরাধী সেই সঙ্গে। সমাজে যদি অন্যায় থাকে, এবং অন্যায়ের যদি শাস্তি না হয়, তাহলে মানুষের মানুষ হওয়া কঠিন হয়। সহজ হয় অপরাধী হওয়া। আজকের দিনে আমরা একটি বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছি। এই ব্যবস্থা শোষণমূলক; এ ব্যবস্থা মানুষ চেনে না, মুনাফা চেনে, এবং একের মুনাফা মানেই হলো অন্যের বঞ্চনা। বঞ্চনাকারীরাই ধনী হয়, ক্ষমতাবান হয়। সম্পত্তি মানেই যে চুরি এ সত্য প্রতিষ্ঠিত। মুনাফা মানে আরো বড় চুরি। সুবিধাবাদী ব্যবস্থা মস্তবড় অপরাধী; তার অধীনে যেসব রাষ্ট্র আছে তারাও অপরাধী। অপরাধীর পক্ষে অপরাধ দমন সম্ভব হবে কি করে? হচ্ছে না। হবে না।

রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে আইন, আছে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা। সমাজ যদি মানুষকে মানুষ করে না তোলে তবে সে অপরাধী, রাষ্ট্রও অপরাধী সেই সঙ্গে। সমাজে যদি অন্যায় থাকে, এবং অন্যায়ের যদি শাস্তি না হয়, তাহলে মানুষের মানুষ হওয়া কঠিন হয়। সহজ হয় অপরাধী হওয়া। আজকের দিনে আমরা একটি বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছি। এই ব্যবস্থা শোষণমূলক; এ ব্যবস্থা মানুষ চেনে না, মুনাফা চেনে, এবং একের মুনাফা মানেই হলো অন্যের বঞ্চনা। বঞ্চনাকারীরাই ধনী হয়, ক্ষমতাবান হয়। সম্পত্তি মানেই যে চুরি এ সত্য প্রতিষ্ঠিত। মুনাফা মানে আরো বড় চুরি। সুবিধাবাদী ব্যবস্থা মস্তবড় অপরাধী; তার অধীনে যেসব রাষ্ট্র আছে তারাও অপরাধী। অপরাধীর পক্ষে অপরাধ দমন সম্ভব হবে কি করে? হচ্ছে না। হবে না।

দোষীদেরকে জেলখানায় পাঠানো হবে, এটাই নিয়ম। তিনটি যুক্তি থাকে এই কাজের পেছনে। শাস্তি, নিবারণ, এবং সংশোধন। দুষ্ট ব্যক্তিটি অপরাধ করেছে, ধরা পড়েছে, প্রমাণ হয়েছে, সাজা পেয়েছে, এখন সে থাকবে কারাগারে। যারা তাকে আটকে রাখছে তাদের মধ্যে একটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা যে কাজ করে না, তা নয়। করে। তারা নিজেদেরকে উন্নত মনে করেন। আশা করেন শাস্তি দেয়ার ফলে অপরাধ কমবে। যে ব্যক্তি শাস্তি পেয়েছে সে আর ওই পথে যাবে না। ভয়ে। অন্যরা দেখে শিখবে। অপরাধ করা থেকে দূরে থাকবে। আশা থাকে সংশোধনেরও। কয়েদী যখন ছাড়া পাবে তখন সে বেরিয়ে আসবে উন্নত মানুষ হিসেবে। 

বাস্তব ক্ষেত্রে এই জাতীয় ঘটনা ঘটে সবচেয়ে কম। জেলখানা সংশোধনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে না। বরঞ্চ উল্টো দায়িত্ব পালন করে। কয়েদীর গায়ে এমন দুরপনেয় ছাপ মেরে দেয় যে, সে যখন বেরিয়ে আসে তখন উন্নত নয়, অবনত হয়েই বের হয়। সমাজে সে সম্মান পাবে আশা করে না। কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চায় না। কাজ দেয় না। ফলে লিপ্ত হয়ে আবার সে অপরাধ করে। আবার জেলে যায়। আর নিবারণ? কারাভোগীর সংখ্যা তো কেবল বাড়ছেই, তাতে তো প্রমাণিত হচ্ছে না যে, দণ্ড পেয়ে কয়েদী ভীত হচ্ছে, কিংবা অন্যরা অপরাধ করতে ভয় পাচ্ছে। 

সমস্যাটা এই যে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় অন্য সব কিছুর মতো বিচারও পণ্যে পরিণত হয়েছে। বড় অপরাধী ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে যায়। টাকার জোরে। ঘুষ দেয়। নামী-দামী উকিল রাখে। জেলখানায় গেলেও ধনী অপরাধী ভালো থাকে, গরীব অপরাধীর তুলনায়। আর ধনী অপরাধীইরা হচ্ছে বড় অপরাধী; বড় বড় মাপের অপরাধী। অন্যের সম্পদ অপহরণ করা অপরাধ। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা অপরের টাকা। সেই টাকা যারা মেরে দিচ্ছে তাদের শাস্তি হয়েছে বলে কেউ শোনেনি। বরঞ্চ লোকে দেখেছে তারাই দাপটে চলে, মন্ত্রী হয়, মেম্বার। মন্ত্রীদের চালায়। আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, তার অপরাধের রোমাঞ্চকর কারণে। জেলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহানায়কের মতো। আর সবচেয়ে বড় যে অপরাধ ছিল তাঁর- রাষ্ট্রক্ষমতা অপহরণ, তার জন্য তো কোনো মামলাই দায়ের করা হয় নি, শাস্তি হবে কী! রাষ্ট্রক্ষমতা অপহরণ অপরাধ নয়, অপরাধ পকেট মারা- এই যদি হয় রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে কে কার বিচার করে, শাস্তি দেয়! নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ' পরিহাসপ্রিয়তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কারাগার প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, খুব ভালো হতো বিচারকরা যদি অপরাধী সেজে ৬ মাস কারাবাস করে আসতেন। 

তাহলে তাঁরা জেলে পাঠাতে দ্বিধা করতেন। জেলখানার অবস্থার উন্নতি না হলে শাস্তি দেবেন না বলে অনমনীয় হয়ে থাকতেন। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা আছে। আর সেটা যে কেবল প্রস্তাব বাস্তবায়নের, তা নয়। সমস্যা এখানেও যে, কারা সংস্কার যতোই করা হোক, কারাগার কারাগারই থাকবে, ওপরে তুললেও নীচে নেমে যাবে। ঘুষ, দুর্নীতি, বরাদ্দ অপহরণ, স্থানাভাব- এসব সহজেই থাকবে। ছ'মাসের মধ্যে যে-কে সেই। কারা-সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়, কারা-কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কারাগার যেখানে ও যে অবস্থায় থাকবার, সেখানেই থাকে। ওঠাতে চাইলেও ওঠানো যায় না। শাস্তি তো দিতেই হবে, এবং শাস্তি দিতে হলে জেলে পাঠানো ছাড়া উপায় কি। যতো বেশী পাঠাবেন, ততোই অবনতি হবে কারাবন্দীদের অবস্থার। রাষ্ট্রের জন্য নিশ্চয়ই আরো 'বড় বড়' কাজ রয়ে গেছে। যে রাজনীতিকরা একসময়ে জেল খেটেছেন, বাইরে এসে তাঁরাও জেলখানার দুরবস্থার বিষয়টা ভুলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা তাদের জন্য আরো জরুরি কাজ রয়ে গেছে। ক্ষমতা দখল করা, বিরোধীদেরকে জেলে পাঠানো, এ সব বড় সোজা কাজ নয়। এ কাজেই ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অত্যন্ত ব্যস্ত রাখে। 

কারা সংস্কার জরুরি, আরো জরুরি সমাজ-সংস্কার। সংস্কারে যে কাজ হবে তাও নয়, প্রয়োজন হচ্ছে সমাজবিপ্লব। অর্থাৎ সেই রকম সমাজ প্রতিষ্ঠার যেখানে অন্যায় থাকবে না, বৈষম্যের অভাব ঘটবে এবং মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে উচ্চতর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে। শত্রুতা থাকবে না, থাকবে মৈত্রী। নির্মূল হবে অপরাধের কারণ। সমাজের এই পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক হবে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা। 

অপরাধীদের বিষয়ে সব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। টলস্টয় খুবই ব্যথা পেয়েছিলেন লন্ডন শহরে আসামীদের প্রতি পথচারীদের আচরণ দেখে। তিনি দেখলেন লোকে পারলে মারে, ঢিল ছুঁড়তে চায়, শাস্তি দিতে আগ্রহী। রুশ দেশে তিনি দেখেছেন ভিন্ন  ব্যাপার। সেখানে অপরাধী দেখলে লোকে করুণা করে, বিষণ্ণ হয়, ভাবে ওই বিপথগামীরা শাস্তির নয় সহানুভূতির পাত্র। এসব পার্থক্য নানা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই ঘটে। যেমন আমরা। আমরা অপরাধী দেখলে মারতেও যাই না, চোখের পানিও ফেলি না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা মোটামুটি উদাসীনতার। এর কারণ রয়েছে। কারণ যাই হোক, এতে অপরাধ কমে না। 
কারাগারে বন্দীরা কেমন আছে সে বিষয়েও উদাসীনতা আমাদের। খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দীরা বিদ্রোহ করেছিল। কেন করেছিল, তা জানবার, এবং জেনে ওই অবস্থাকে ধিক্কার দেবার অবকাশ ঘটে নি। বাংলাদেশ আমলে যশোর জেলে বন্দীরা যে 'মুক্তি অথবা মৃত্যু' বলে বিদ্রোহ করলো তার নাটকীয়তা দেখেছি আমরা, কারণ দেখতে চাই নি। 

উদাসীনতা বাড়াবার অনেক প্ররোচনা রয়েছে। এই জিনিসটা ভালো নয় মোটেই। উদাসীনতায় ব্যবস্থা বদলাবে না। আমরা প্রত্যেকেই কারাগারে আছি, বন্দিত্বের নানান যন্ত্রণায় ছটফট করছি- এই বোধ উদাসীনতাকে বৃদ্ধি করছে। কিন্তু তাতে সমাজ বদলাবে না; রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি থাকবে, কিংবা আরো খারাপ হবে। এবং বন্দীরা বন্দীই রয়ে যাবে- যেমন জেলখানায়, তেমনি জেলের বাইরে। রাষ্ট্রকে চিনবার সর্বোত্তম উপায় জেলখানায় যাওয়া; একাধিক অর্থে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

1h ago