সংবাদ বিশ্লেষণ: জাতীয় পার্টির পদাঙ্ক অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগ?
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সংসদে এমপিরা যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন তা চতুর্থ জাতীয় সংসদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি তখন ক্ষমতায় ছিল। এ থেকে মনে হতে পারে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা এখন জাতীয় পার্টির তখনকার সাংসদদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন।
২৭ বছর আগে এরশাদের নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল চতুর্থ জাতীয় সংসদ। সে সময় অষ্টম সংশোধনী আংশিকভাবে বাতিল করে দেওয়ায় সংসদ থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও তার বিচারকদের আক্রমণের নিশানা বানানো হয়েছিল।
১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে অষ্টম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। ওই রায়ে ক্ষুব্ধ এমপিরা ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদে আলোচনায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমালোচনা করতে গিয়ে অসংসদীয় ও অশালীন ভাষা প্রয়োগ করতে ছাড়েননি।
অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল সেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার পর দশম জাতীয় সংসদে এবার আওয়ামী লীগের এমপিদের তোপের মুখে পড়তে হল সুপ্রিম কোর্টকে।
চতুর্থ জাতীয় সংসদের সাথে দশম জাতীয় সংসদের অনেক দিক থেকেই মিল রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে বোঝার জন্য এই মিলগুলো আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।
১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল চতুর্থ জাতীয় সংসদ। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি খুব সহজেই ওই নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন: সংবাদ বিশ্লেষণ: এমপিদের ক্ষোভ সম্পূর্ণ অন্যায্য
ওই পার্লামেন্টকে বৈধতা দিতে কৌশলের আশ্রয় নেয় সরকার। আ স ম আব্দুর রবকে তথাকথিত বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে নিজের ক্ষমতাকে সংহত করার পথ বেছে নেন এরশাদ। তখন এ নিয়ে ঠাট্টাতামাসা কম হয়নি। গণতন্ত্রপন্থি প্রায় সবগুলো বড় দল তখন রবের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলকে সরকারের ‘গৃহপালিত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।
চতুর্থ সংসদ গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই নিজের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করতে এরশাদ সরকার সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ করে। এই সংশোধনীতে রাজধানীর বাইরে হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ স্থাপনের বিধান ও ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কিন্তু সংশোধনীটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপন্থি আখ্যা দিয়ে ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত রাজধানীর বাইরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চের বিধানটিকে বাতিল করে দেন।
দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হওয়ার অনেক বছর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। একতরফা এই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ বেশ কয়েকটি দল। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তিন চতুর্থাংশ আসনে জয় পায়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কোন রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা পর্যন্ত হয়নি। অন্যদিকে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত মাত্র ১৮ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলেন।
এবার এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সংসদে বিরোধী দল বানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে এনে ষোড়শ সংশোধনী পাস করে সরকার।
কিন্তু এই সংশোধনীকে বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে বাতিল করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এই সংশোধনীকে বাধা হিসেবে দেখেছেন আদালত।
কিন্তু বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা এই রায়ে খুশি হতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে তারা সংসদে আলোচনা করেছেন। মাননীয় সাংসদগণ দলের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে নিশানা বানিয়েছেন। গত বছর মে মাসে হাইকোর্টে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সংসদের একই রূপ দেখা গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!
স্পিকারের ভূমিকাতেও চতুর্থ জাতীয় সংসদের সাথে বর্তমান সংসদের মিল রয়েছে। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের এক অঙ্গ আইনসভার প্রধান, স্পিকার যিনি রাষ্ট্রের অপর অঙ্গ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে বিনা বাধায় এমপিদের সমালোচনামূলক বক্তব্য চালিয়ে যেতে দিয়েছেন।
সংসদে যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা হয়েছে তা কোনভাবেই— আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ—রাষ্ট্রের এই রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের আন্তঃসম্পর্কের জন্য ইতিবাচক নয়।
দুই ঘটনাতেই বিচার বিভাগের সমালোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ আইন বিভাগের সাথে হাত মিলিয়েছে।
বিচার বিভাগের সংবেদনশীলতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকদের বিচার কাজে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই স্বাধীনতার ফলে বিচারকরা সব ধরনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিণতি অগ্রাহ্য করে আইন অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৩৩, ২৭০ (iii) সহ অনেকগুলো ধারায় বিচারবিভাগ ও বিচারকদের বিরুদ্ধে অবমাননামূলক বক্তব্য প্রদানে সাংসদদের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে।
এর পরও কোন এমপি বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করলে স্পিকারের ওপর দায়িত্ব বর্তায় এমপিদের এমন বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত রাখা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখনই বিচার বিভাগ ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের আক্রমণের লক্ষ্য হয় স্পিকার তা থামানোর উদ্যোগ পর্যন্ত নেন না। আইনসভার প্রধান তখন সংসদের আগে দলকে প্রাধান্য দেন ঠিক যেমনটা ৭০ অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতার জন্য করেন এমপিরা।
সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। সংবিধানই তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোন আইন বাতিল করতে পারেন।
এই ক্ষমতাবলেই সুপ্রিম কোর্ট সংসদে পাশ হওয়া সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী ও আইন বাতিল করেছেন। এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ক্ষুব্ধ এমপিদের আচরণ তাদের সীমা লঙ্ঘন ও সংসদের দায়মুক্তি সুবিধার অপব্যবহার বলে বিবেচিত হতে পারে।
অষ্টম ও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর যে এমপিরা সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণ করেছেন তারা সংবিধান নির্ধারিত তাদের সীমা অতিক্রম করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
চতুর্থ ও দশম জাতীয় সংসদের মধ্যকার চরিত্রগত সাদৃশ্য আমাদের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকেই প্রতিফলিত করে। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি।
Click here to read the English version of this news analysis
Comments