সৌদি নারী সমাজে পরিবর্তনের হাওয়া
মেয়েদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে বাধা তুলে নিতে মঙ্গলবার সৌদি বাদশাহ সালমান বিন বাব্দুলআজিজ যে আদেশ জারি করেছেন সেটিকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বলা যাবে না। ধীরে হলেও বেশ কয়েক বছর থেকেই সৌদি আরবের সমাজ একটি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
এতদিন সৌদি আরবই ছিল পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে মেয়েদের গাড়ি চালানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হত। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন অনেক বছর থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল। গাড়ি চালানোর ‘অপরাধে’ অনেক নারীকে সাজাও পেতে হয়েছে সেখানে। গাড়ি চালানোর আইনগত অধিকার পাওয়ার মাধ্যমে সৌদি নারীদের ওপর দীর্ঘদিন থেকে চেপে থাকা জগদ্দল পাথর একটু হলেও সরল।
১৯৩২ সালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটিতে কঠোর শরিয়া আইন চলছে। এই আইনের কারণে সৌদি নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা অনেকটাই সীমাবদ্ধ। আইনগত ব্যাপারে মেয়েদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়। এর সাথে ছিল গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা।
সৌদি সমাজের এই পরিবর্তনটা মূলত দৃশ্যমান হয়েছে বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুলআজিজ আল সৌদের কিছু পদক্ষেপে। তিনি সৌদি নারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি তাদের সমান ভোটাধিকার দিয়েছেন। ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে নারীরা প্রথম ভোট দেওয়ার আইনি অধিকার লাভ করেছিল। এরপর ইউরোপ হয়ে বিশ্বব্যাপী নারীরা ভোটাধিকার পেলেও সৌদি নারীদের এর জন্য ২০১১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। নির্বাচনে লড়াই করে ১২ জন সৌদি নারী জয়লাভও করেছেন।
২০১৫ সালে সৌদি সরকার আরেকটি তথ্য প্রকাশ করে যা তখন অনেককেই অবাক করেছিল। সে বছর দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। মে মাসে প্রকাশ করা পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১ দশমিক ৮ শতাংশই নারী। এতদিন পর্যন্ত অনেকেই মনে করতেন সৌদি আরবের নারীরা অনেক মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত। এই তথ্য তাদের ধারণার ভিত্তিমূলে আঘাত করে।
নারীদের ভোটাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি ২০১১ সালেই ১৫০ সদস্যের সুরা কাউন্সিলে প্রথমবারের মত নারীদের যুক্ত করার ঘোষণা দেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। ঘোষণার দুই বছর পর ২০১৩ সালে ৩০ জন নারীকে সুরা কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত করে ন্যূনতম এক পঞ্চমাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের ইতিহাসে প্রথমবারের মত নারীরা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও ১২ জন নির্বাচিত হন।
২০১৩ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন সৌদি নারী রাহা মোহাররাক (২৫)। রাহা শুধু প্রথম সৌদি নারীই নন, আরব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী এভারেস্ট জয়ীও তিনি। জেদ্দায় রাহার জন্ম। তিনি দুবাইয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। রাহার সামনে বাধা হয়ে ছিল রক্ষণশীল সৌদি সমাজ, যা জয় করেই এভারেস্টে চড়তে হয়েছে তাকে।
২০১৭ সালে প্রথমবারের মত সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারী অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে রিয়াদে নারী দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ পরিবারের সদস্যরাও যোগ দেন।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন সৌদি সুরা কাউন্সিলের নারী সদস্য হোদা আল-হেলাইসি। সেসময় দ্য ডেইলি স্টার তার সাক্ষাৎকার নেয়। সৌদি সমাজে নারীদের অবস্থার পাশাপাশি তাদের চাওয়া-পাওয়ার নানা দিক উঠে আসে তার কথায়।
বিশেষ ওই সাক্ষাৎকারে আল-হেলাইসি বলেন, “সৌদি নারীরা এখন নিজেদের পেশাগত জীবনে দেখতে চায়। তারা কাজের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির অংশ হতে চায়।” সৌদি সমাজ আগের তুলনায় অনেকটাই নারীবান্ধব হয়ে উঠছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মেয়েরা যেন চাকরির সুযোগ পেতে পারে সেটার ব্যবস্থা করাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য।”
২০৩০ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সৌদি সরকার। এই মহা-পরিকল্পনার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় কার্যকর সংস্কার আনা যেন সৌদি তরুণরা চাকরির জন্য নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে পারেন। এই মহাপরিকল্পনার আরেকটি বড় অংশ হল পর্যটন ব্যবসাকে জমজমাট করে তোলা। এর জন্য লোহিত সাগরের অন্তত ৫০টি দ্বীপ নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করছে দেশটি। এসব দ্বীপ ও আরও কিছু জায়গায় তৈরি করা হবে বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র।
সৌদিতে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিদেশি নারী পর্যটকদেরও জন্যও পোশাকে আবৃত থাকা বাধ্যতামূলক। তবে নতুন যেসব পর্যটনকেন্দ্র করা হবে সেখানে এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না। আন্তর্জাতিক মানের এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে থাকবে সিনেমা, থিয়েটারসহ বিনোদনের সব সুবিধা।
দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে নতুন ঘটনাই বলা চলে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত মেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার রুদ্ধ ছিল। ১৯৭০ সালে সৌদি নারীদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র দুই শতাংশ। আর সেখানেই এখন ৯১ শতাংশ নারী নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত। দেশটির সরকারও গর্ব করে বলছে নারীদের মধ্য থেকে নিরক্ষরতা ঝেঁটিয়ে বিদায় করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন তারা।
নারী শিক্ষায় অর্জনের কথা বলতে গিয়ে আল-হেলাইসি সেসময় গর্বের সাথেই বলেন, “অনেক বছরের চেষ্টায় আমরা মেয়েদের মধ্য থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে সক্ষম হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী গ্র্যাজুয়েটরা মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই ভালো করছে।”
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এখন সৌদি মেয়েদের পদচারণা। শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা ও সেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী ৬০টির মত দেশে সৌদি মেয়েরা যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে ৩৫ হাজারের বেশি নারী শিক্ষার্থী বিদেশে পড়ালেখা করছিল। শিক্ষাবৃত্তি নিয়েও অনেক সৌদি মেয়ে এখন বিদেশে পড়ালেখা করতে যাচ্ছে।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয় সামাজিকভাবেও নারীদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন এই এমপি। তিনি জানান, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সৌদি মেয়েরা এখন দেরিতে বিয়ে করছেন। আগে যেখানে গড়পড়তা ১৮ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত সেখানে এখন ২৫-২৬ বছরের আগে মেয়েরা বিয়ে করছেন না। অনেকেই তো ২৯-৩০ বছরেও বিয়ে করছেন।
পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে সৌদি আরবের পরিবারগুলোতেও। আগে প্রতিটি পরিবারে ১০-১২ জন পর্যন্ত সন্তান নেওয়া হত এখন সেখানে এই সংখ্যা ৩-৪ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। আর এই সব কিছুর ফলেই সমাজের মূল ধারায় আসার সুযোগ পাচ্ছে সৌদি মেয়েরা। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সৌদি নারীদের।
Comments