স্মৃতির অতলে সেদিনের গণহত্যা

bogra-mass-grave
(১) ভুল বানানে ভরা বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চৌধুরীবাড়ির শহীদদের অসম্পূর্ণ নামফলক। (২) চৌধুরীবাড়ির শ্যাম সরোবরের কাছে ২৩ এপ্রিলের শহীদদের বধ্যভূমি। (৩) দুপচাঁচিয়া চৌধুরীপাড়ার ঐতিহ্যবাহী চৌধুরীবাড়ি, যেখানে ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাঁচ বছরের শিশুসহ একই পরিবারের নয়জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ছবি: অমিত কুমার কুণ্ডু রাজিব

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল। এক হৃদয়বিদারক চিৎকারে ভরে উঠেছিল চারপাশ! মৃত্যুকূপ থেকে রক্ষা পায়নি পাঁচ বছরের অবুঝ শিশুও। পাকিস্তান হানাদারবাহিনী বেয়নেট ঢুকিয়ে দিয়েছিল পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু কাকলীর বুকে। তারপর ফুটফুটে  শিশু কাকলীকে আছড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল সিঁড়ির উপর! ছোট্ট শরীরের রক্তে ভিজে গিয়েছিল বগুড়ার দুপচাঁচিয়া চৌধুরীবাড়ির সিঁড়ি আর মেঝে। অবশেষে ছোপ ছোপ রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কাকলীর অবুঝ প্রাণ, থেমে গিয়েছিল শেষ ক্রন্দনরোল!

বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে দুপচাঁচিয়া থানা সদরে পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে সেদিন। লুণ্ঠন, ধর্ষণ আর গণহত্যার বীভৎসতায় পাকিস্তানি হায়েনাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আব্দুল মজিদ, মজিবর রহমান ও তাদের দোসররা। সেদিন তাদের হাতে প্রাণ হারায় নাম না জানা অসংখ্য নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ।

এর আগে রাজাকারদের নেতৃত্বে কয়েকটি মন্দিরের স্বর্ণালংকার, কাঁসার তৈজসপত্র, অর্থকড়িসহ সবকিছু লুটপাট করা হয়। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় রাজনীতিবিদ ডা: আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকান ও আশেপাশের ঘরবাড়িতে। ঐদিনই রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় দুপচাঁচিয়া চৌধুরীপাড়ার ঐতিহ্যবাহী চৌধুরীবাড়িতে।

পাকহানাদার বাহিনীর বগুড়া আক্রমণের পর জীবন বাঁচানোর তাগিদে আগের দিন ২২ এপ্রিল চৌধুরীবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী ওরফে ক্ষিতীশ চৌধুরীর আত্মীয় মন্মথ কুণ্ডুর পরিবার-পরিজন। তাঁরাও বাঁচতে পারেননি সেদিন। হানাদারবাহিনীর ব্রাশফায়ারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বেশ কয়েকজন। সেদিনের সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী ওরফে ক্ষিতীশ চৌধুরী, মন্মথ কুণ্ডু, দূর্গা কুণ্ডু, কালাচাঁদ কুণ্ডু, সন্তোষ কুণ্ডু, কানাইলাল পোদ্দার, ব্রজমোহন সাহা, পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু কাকলীসহ আরও কয়েকজন। ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার তহিরউদ্দিন শাহ, ওষুধ ব্যবসায়ী সতীশ চন্দ্র বসাক, শরৎ মজুমদার, অক্ষয় কুণ্ডুসহ তৎকালীন মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজারের পরিবারের কেউই রক্ষা পায়নি ২৩ এপ্রিলের নির্মম গণহত্যা থেকে।

গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ভান করে পড়ে থাকেন শুধু মন্মথ কুণ্ডুর মেয়ে তৃপ্তি রাণী। পরিবার-পরিজনসহ নয়জনকে সেদিন হারিয়ে তৃপ্তি ভাগ্যবশত প্রাণে বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে তাঁকে জীবিত অবস্থায় কাটাতে হয় মৃত্যুর অনুভূতিময় বীভৎস জীবন। পাকিস্তানি হায়না থেকে শুরু করে রাজাকার দোসরদের কাছে তৃপ্তিকে হতে হয়েছিল গণধর্ষিত! হানাদার বাহিনী বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটানা গোলাগুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় মন্দিরের ফটক, চৌধুরী বাড়ির প্রবেশদ্বার। বুলেটবিদ্ধ করা হয় চৌধুরীবাড়ির ফটকে শোভিত স্বনামধন্য ভাস্কর নলিনীমোহন কুণ্ডুর হাতে গড়া কারুকার্যপূর্ণ বিভিন্ন ভাস্কর্য।

নিথর অবস্থায় পড়ে থাকা লাশগুলোর সদগতি হয়নি পরদিনও। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দূরে থাক, হানাদার বাহিনীর ভয়ে নিজ মাতৃভূমিতে কবর খুঁড়ে চিরদিনের জন্য একটু শান্তিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেওয়ারও কেউ ছিল না সেদিন! দুদিন পর এ হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়ে ছুটে আসেন নিমাইসুন্দর চৌধুরী, অনন্তমোহন কুণ্ডু, বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী ও জয়ন্ত কুণ্ডু। শোকে স্তম্ভিত হন তাঁরা। অন্য উপায় না পেয়ে নিজের হাতে তাঁদের জন্য গণকবর খুঁড়ে লাশগুলো সমাধিস্থ করেন চৌধুরীবাড়ির শ্যাম সরোবরের সন্নিকটে।

উল্লেখ্য, বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এলাকার জনসাধারণের সমর্থনে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম শাহজাহান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে রাজাকার আব্দুল মজিদ ও মজিবর রহমান দেশদ্রোহিতার উপযুক্ত শাস্তি পায়।

স্বাধীনতার পর সেই বধ্যভূমিটি ইটের দেয়াল দিয়ে অস্থায়ীভাবে ঘিরে রেখেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী  অনন্ত মোহন কুণ্ডু, নিমাইসুন্দর চৌধুরী ও জয়ন্ত কুণ্ডুসহ আরও অনেকে। কিন্তু কালের গর্ভে প্রাকৃতিক অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝায় তা হারিয়ে গিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের একচল্লিশ বছর পরে দুপচাঁচিয়ার এই বধ্যভূমিটি উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে সাময়িক সংস্কার করা হয়েছে। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সেখানে নামফলকও নির্মাণ করা হয়েছে।

তবে স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো স্মৃতিস্তম্ভের দেখা মেলেনি দুপচাঁচিয়া চৌধুরীবাড়ি বধ্যভূমির। এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলেনি সেদিনের গণহত্যার, লিপিবদ্ধ করা হয়নি সেই দিনটিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুপচাঁচিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহেদ পারভেজ জানান, “সেদিনের গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণে ও বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোন নির্দেশ পাওয়া যায়নি।” নির্দেশ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

দুপচাঁচিয়া চৌধুরীবাড়ি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ। “ওই বধ্যভূমির বর্তমান নামফলকে কয়েকজন শহীদের নাম বাদ পড়েছে এবং কিছু নামের বানানও ভুল রয়েছে” বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে তিনি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাসও দেন।

শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি সংরক্ষণে সে এলাকায় যাতায়াতের স্থানীয় সড়কের সাথে নতুন সংযোগ রাস্তা নির্মাণসহ আশেপাশে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা জরুরী বলে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানায় এলাকাবাসী। এ পর্যন্ত বধ্যভূমির আশেপাশে কোন পাকাসড়ক নির্মাণ হয়নি।

সেদিনের গণহত্যার স্বীকৃতি পাওয়ার প্রতীক্ষায় দুপচাঁচিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

 

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

16h ago