ফ্যাক্টস অ্যান্ড অল্টারনেটিভ ফ্যাক্টস

গত ২২শে জানুয়ারি সংসদে এক আলোচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য গণমাধ্যমের কঠোর নিন্দা করেছেন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের শোক প্রস্তাবের আলোচনার সময়, তারা গণমাধ্যমকে তীব্র আক্রমণ করে দাবি করেছেন ২০১৫ সালের একটি শিশুকে গুলি করে আহত করার ঘটনার আসল সত্য গণমাধ্যম প্রকাশ করেনি।
২০১৫ সালে গাইবান্ধায় শিশুকে গুলি করার ঘটনাটি দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমে এর ব্যাপক প্রচার দেখা যায়। দেশের সব প্রধান দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকাল, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠ এবং দ্য ডেইলি স্টার প্রায় একই কথা লিখেছিল - সংসদ সদস্য লিটন ছেলেটিকে গুলি করেছেন।
গণমাধ্যমে ছাপানো সেই খবরের সূত্র ছিল আহত সেই শিশুটির পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয় লোকজন। শিশুটির বাবা সংসদ সদস্য লিটনকে অভিযুক্ত করে হত্যাচেষ্টার মামলাও করেছিলেন।
কিন্তু সংসদে আলোচনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই ঘটনার অন্য বর্ণনা শোনালেন। তারা দাবি করেন, সেসময় দুর্বৃত্তরা সেখানে ওত পেতে ছিল লিটনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এবং তিনি আত্মরক্ষার জন্য গুলি করেছিলেন। তারা দাবি করেন, সংসদ সদস্য লিটন শিশুটিকে গুলি করেননি।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা তাদের অনুসন্ধানে যা পেয়েছে তার সঙ্গে সংসদের আলোচনার মিল নেই। অনুসন্ধানে উঠে আসা ঘটনা আর পত্রিকার ছাপা ঘটনা একই।
সুন্দরগঞ্জ থানার অনুসন্ধানে দুর্বৃত্তদের লিটনকে খুন করার উদেশ্যে ওত পেতে থাকার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যেমনটি সংসদে দাবি করা হয়েছে গণমাধ্যমে নিন্দা করার জন্য।
একটি সবিবেচনাপূর্ণ অনুসন্ধানের পর, পুলিশ সংসদ সদস্য লিটনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৪ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে ইচ্ছাকৃত আঘাতের দায়ে, গাইবান্ধা কোর্টে চার্জশিট জমা দেয়।
গত বছর ১ এপ্রিল অতিরিক্ত প্রধান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বলেন, “দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৪ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলো এমপি লিটনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে”। আদালত সেই এমপির উন্মুক্ত আদালতে শুনানির প্রার্থনা করেন।
ঘটনা বর্ণনা করে চার্জশিটে বলা হয়: “২০১৫ সালের ২ অক্টোবর সকালে, ১০ বছর বয়সী সৌরভ মিয়া তার আত্মীয়ের সাথে গোলাপচারণ গ্রামে হাঁটতে বের হয়। সেইসময় এমপি লিটন তার পাজেরো জিপে করে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। তিনি সৌরভকে দেখেন এবং কাছে ডাকেন। সৌরভ কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানালে, বিবাদী মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন রেগে যান এবং তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেন। গুলিটি শিশুর পায়ে লাগলে সে আহত হয়।”
চার্জশিটে আরও বলা হয়: “প্রত্যক্ষদর্শীরা সৌরভকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সংসদ সদস্য লিটনের পিস্তলটি পরীক্ষা করার জন্য জব্দ করা হয়। পিস্তলটির উপরে পরীক্ষা চালিয়ে এবং অনুসন্ধানের পর দেখা যায়, সৌরভের পায়ে লাগা গুলিটি এই জব্দ করা পিস্তল থেকেই করা হয়েছে।”
ঘটনাটির কারণে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিলে সরকার তখন লিটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন তন্ন তন্ন করে লিটনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তিনি সেসময় গা ঢাকা দিয়েছিলেন।
লিটন একই বছর ১২ অক্টোবর হাইকোর্টে দুটি আলাদা পিটিশন করে আগাম জামিনের প্রার্থনা করেন। দুটি পিটিশনই হাইকোর্ট নামঞ্জুর করেন এবং এমপি লিটনকে গাইবান্ধা আদালতে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখন দ্বিধায় ভুগছে, ১৮ই অক্টোবরের আগে লিটনকে তারা গ্রেফতার করবে কিনা।
সেই সময় এটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের আত্মসমর্পণ আদেশের বিরুদ্ধে, সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগে আর্জি দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হাইকোর্টের নির্দেশটি স্থগিত করে দিলে, লিটনকে গ্রেফতারের পথ খুলে যায়।
গোয়েন্দা বাহিনী সংসদ সদস্য লিটনকে রাজধানীর উত্তরা থেকে ১৪ অক্টোবর রাতে গ্রেফতার করে। একই রাতে গোয়েন্দা বাহিনীর একটি দল লিটনকে নিয়ে গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং পরে তাকে গাইবান্ধা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
পরদিন লিটনকে গাইবান্ধা আদালতে হাজির করা হয়। তার জামিনের আর্জি নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
যদিও গত বছরের ৮ নভেম্বর গাইবান্ধা কোর্ট তার অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে যেন তিনি সেদিনের সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। পরবর্তীতে তাকে স্থায়ী জামিন দেয়া হয়।
তিনি এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে আবেদন করেন। আবেদনটি বাতিল করা হয়নি। লিটনের পক্ষে উকিল সিরাজুল ইসলাম বাবু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত ৫ জানুয়ারি ২০১৭ চার্জশিটের শুনানির দিন ধার্য করেছিলেন আদালত।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তে তার আকস্মিক মৃত্যুতে ৫ জানুয়ারি মামলাটির শুনানি আর করা হয়নি।
অতএব, ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের সংসদে আলোচনায় গণমাধ্যমকে আক্রমণ করা বক্তব্য পুলিশের দেয়া মামলাটির চার্জশিটের বিপরীত।
মজার ব্যাপার হলো, দুর্বৃত্তদের ওত পেতে থাকা, এবং সংসদ সদস্য লিটনের আত্মরক্ষায় গুলি করার ঘটনাটি আগে কখনই পুলিশের বক্তব্যে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের এবং লিটনের নিজের কথায় উঠে আসেনি, যদিও তার বক্তব্যে এই বিষয়ে আরও অনেক কথা ছিল।
অনুবাদ: সুমাইয়া জামান
Comments