২ আফগান যুবকের চোখে তালেবানের ক্ষমতা দখল

২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে চলে গেছে আমেরিকান সৈন্যরা। এর ফলে প্রায় কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে তালেবানরা। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন ভয়ের এবং আতংকের।
afghanistan
(বামে) কাবুল বিমানবন্দরের দিকে ছুটছেন মানুষ। (ডানে) ইরফানউল্লাহ ইরফান। আলী খানের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তার ছবি প্রকাশ করা হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে চলে গেছে আমেরিকান সৈন্যরা। এর ফলে প্রায় কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে তালেবানরা। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন ভয়ের এবং আতংকের।

দেশটির সাধারণ মানুষ দেশ ছাড়ার জন্য কাবুল বিমানবন্দরে ছুটছে । এর ফলে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এ ছাড়াও, অনেক জায়গায় মানুষ তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছে। তালেবানদের গুলিতে মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এই পরিস্থিতিতে তালেবানরা কীভাবে সরকার গঠন করবে? কী হবে আফগান মানুষের ভবিষ্যৎ? আফগানিস্তান কি একটি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আফগানিস্তানের বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে দুটি গোষ্ঠীর দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের একজন আলী খান (৩০)। আলী খান বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শদাতা ছিলেন এবং আফগানিস্তানের গনি সরকারের সময় নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। আফগানিস্তানের হাজারা জাতিগোষ্ঠীর যুবক আলী খান তার পরিবার নিয়ে কাবুলে বসবাস করছেন। অপরজন ইরফানউল্লাহ ইরফান (২৮)। আফগানিস্তানে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর হয়ে কাজ করেন তিনি। দেশটির প্রভাবশালী পশতুন জাতিগোষ্ঠীর যুবক ইরফান কুনার প্রদেশে থাকেন।

 

দ্য ডেইলি স্টার: এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কী? যুদ্ধ নেই, তারপরও মানুষ কেন দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরের দিকে ছুটছে? কেন এতো ভয় তাদের?

আলী খান: তালেবানরা ক্ষমতা দখল করার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। তারপরও যারই সুযোগ আছে, দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছে। কাবুল বিমানবন্দরে আমেরিকান সৈন্যরা পশ্চিমা নাগরিক এবং তাদের আফগান মিত্রদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে ২৪ ঘণ্টা। তবে যারা দেশ ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে তাদের ৮০ শতাংশই পশতুন, যারা আমেরিকান ও পশ্চিমাদের সঙ্গে অনুবাদক, দোভাষী, কর্মচারী এবং সহযোগী হিসাবে গত ২০ বছর কাজ করেছে। তবে ক্ষমতাসীন পশতুনরা তালেবানদের ভয়ে নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর পাসপোর্ট, ভিসা এবং নাগরিকত্বের সুযোগ নেওয়ার জন্য দেশ ছাড়ছে।

ইরফানউল্লাহ ইরফান: শুরুতে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়েছিল। তাদের ভয় ছিল, তালেবানরা তাদের ওপর অত্যাচার চালাবে অথবা তাদের মেরে ফেলবে। কিন্তু তালেবানরা এখনও তেমন কিছু করেনি। বরং তাদের পক্ষ থেকে সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে।

 

ডেইলি স্টার: মার্কিন বা পশ্চিমা দেশগুলোর শক্তিশালী সহায়তা এবং বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের পরও আশরাফ গনির শাসন কেন ব্যর্থ হলো? আফগান সেনাবাহিনী তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করল না কেন?

আলী: আশরাফ গনির পতনে আমি খুশি, যদিও আমি তালেবানদের বিশ্বাস করি না। আশরাফ গনির শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্নীতি, অন্যায়, স্বজনপ্রীতি এবং পশতুন জাতীয়তাবাদের আঁতুড় ঘর। অতীতে হামিদ কারজাইয়ের শাসনামলেও তাই হয়েছিল। এজন্যই তাদের পতন হয়েছে। এর জন্য পশ্চিমা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আমি বেশি দায়ী করব আফগান টেকনোক্র্যাটদের।

দুর্নীতি এবং পশতুন জাতীয়তাবাদের কারণেই তালেবানরা ধীরে ধীরে শাসন ক্ষমতা লাভের সুযোগ পেয়েছে। কারজাই এবং গনি দুজনই পশতুন এবং দুজনেরই তালেবানদের প্রতি সহানুভূতি ছিল। তারা চেয়েছিলেন তালেবানদের দিয়ে অন্য জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে তাজিকদের দমিয়ে রাখতে। (আফগানদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রভাবশালী জাতিগত গোষ্ঠী তাজিক)।

ইরফান: জাতিগত পক্ষপাতের কারণে আগের সরকারগুলো ভেঙে পড়েছে।

 

ডেইলি স্টার: আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ কী তালেবানদের ওপর আস্থা রাখছে?

ইরফান: তালেবানরা আফগানিস্তানের জাতি গঠনের জন্য কাজ করতে চায়। এবার আমরা তাদের স্বাগত জানাই। তারা দেশের উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা ভালো দিক বলে মনে করছি।

তারা বলেছে, অতীতে যা হয়েছে তা তারা ভুলে গেছে। নতুন কৌশল নিয়ে জাতি শাসনে তারা উন্মুখ। এ ছাড়া, দেশের মানুষ এখন নিজেদের শাসন চায়, বিদেশি শাসন নয়।

আলী: না, দেশের সাধারণ মানুষ তালেবানদের বিশ্বাস করে না। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুনরাই তাদের বিশ্বাস করতে পারে, অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী নয়। আমি আগেই বলেছি, আশরাফ গনির সময়ে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার এবং পশতুন জাতীয়তাবাদ  আফগানিস্তানের মানুষকে তালেবানের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগের বার, তালেবানদের আদালত স্বচ্ছ ছিল এবং গনি শাসনের চেয়ে দ্রুততম সময়ে অন্যায়ের বিচার করেছিল।

 

ডেইলি স্টার: তালেবানরা যদি এখন নতুন সরকার গঠন করতে চায়, তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে?

আলী: তালেবানদের শরিয়া মতাদর্শই তাদের প্রধান বাধা হতে পারে। তা ছাড়াও তালেবানরা আফগানদের সঠিকভাবে শাসন করতে পারবে না।    তাদের অধিকাংশই দুররানি পশতুন এবং গ্রাম এলাকা থেকে এসেছে। শহুরে জীবন সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। সরকার চালানোর জন্য যে আমলাতন্ত্র প্রয়োজন, সেটা তাদের নেই।

ইরফান: তারা বিশ্বের অন্যান্য জাতির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক। তালেবানরা একটি ঐক্যের ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। জাতিগত ঐক্য বজায় রাখাই হবে তাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।

 

ডেইলি স্টার: তালেবানরা যদি আবার তাদের আগের শাসনামলের মতো আইন প্রয়োগ করে, তাহলে মেয়েদের শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন, স্বাধীন সাংবাদিকতা, এনজিও কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অন্যান্য প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে কী হতে পারে? তারা কি আর কাজ করতে পারবে?

ইরফান: দেখুন, আমরা মুসলমান এবং আমাদের শরিয়া আইন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তালেবানরা কীভাবে এই আইনের প্রয়োগ করবে তা এখনও অজানা।

তারা ইতোমধ্যে নারীদের কাজের অনুমতি দিয়েছে এবং সাংবাদিকতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কোনো সমস্যা নেই। তালেবানরা এটাও বলেছে, তারা এমন কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয় যারা শরিয়া আইন মেনে চলে।

আলী: পুরো বিশ্ব এখন তালেবানের কার্যক্রম দেখছে। তালেবানরা এখন বলছে যে, তারা নিজেদের পরিবর্তন করেছে। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের পরিবর্তন কখনোই হবে না। ধীরে ধীরে তারা সব কিছুর ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করবে। ঠিক যেমনটা তারা এর আগেও করেছিল। এটা আমাদের সবার জন্য সমস্যা তৈরি করবে। বিশেষ করে আমরা যারা প্রজাতন্ত্রের যুগে বেড়ে উঠেছি, যেখানে শরিয়া আইনের কোনো কড়াকড়ি ছিল না, তাদের জন্য সমস্যা বেশি হবে। তালেবানদের শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা খুবই সংকীর্ণ ধরণের।

যদিও তারা বলছে, তারা নিজেদের পরিবর্তন করেছে। কিন্তু শিগগির তারা মানুষের স্বাধীনতার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। কারণ তালেবানের মূল বিশ্বাস শরিয়া আইনে। আর যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে তারা আর তালেবান থাকবে না।

 

ডেইলি স্টার: আফগানিস্তানের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং তালেবানরা অতীতে কিছু মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করেছে। তারা কি আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য হুমকি?

ইরফান: হ্যাঁ, তারা গতবার বামিয়ানে কিছু ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা সেটা নাও করতে পারে। কারণ গত দুই দশকে বিশ্ব অনেক বদলে গেছে। তাই তালেবানরা এবার অন্য সুরে কথা বলছে।

আলী: আমি আগেও বলেছি, তারা শিগগির তাদের আসল রূপ দেখাবে।

 

ডেইলি স্টার: গত ৪০ বছর ধরে আফগানিস্তান ছিল বিশ্ব রাজনীতির একটা খেলার মাঠ, বিশেষ করে রাশিয়া ও আমেরিকার। এখন কে খেলবে?

আলী: পাকিস্তান, ইরান, চীন এবং রাশিয়া হবে বড় খেলোয়াড়। ভারত চলে যাবে বৃত্তের বাইরে।

ইরফান: তালেবান সরকারের উচিত হবে সব জাতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

 

ডেইলি স্টার: আফগানিস্তান ক্রিকেট দল এবং অন্যান্য খেলাধুলার কি হবে?

ইরফান: আমরা আমাদের ক্রিকেট দল নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের ভালো করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি আফগান ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেবে।

আলী: আমি জানি না যে এ দেশে খেলাধুলা এবং আফগান ক্রিকেট দলের জন্য কি অপেক্ষা করছে।

 

ডেইলি স্টার: আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে গৃহযুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

আলী: এক বা দুবছরের মধ্যে আমাদের আরেকটি গৃহযুদ্ধ দেখতে হতে পারে। কিন্তু সেটা নির্ভর করবে কীভাবে তালেবানরা উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অন্য জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করবে কি না, এমন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। যদি তারা অন্য জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত না করে তাহলে একটি গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হবে। বিশেষ করে তাজিক, হাজারা এবং উজবেক এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে উঠবে তালেবানদের বিরুদ্ধে।

আমাদের একটি সমৃদ্ধ জাতিগত বৈচিত্র্য আছে। তারপরও আমরা সবসময় পশতুনদের দ্বারা শাসিত হয়েছি। আফগান সংবিধান ১৬টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতির দিলেও গবেষকদের মতে ৪০টির বেশি জাতিগোষ্ঠী বাস করে আফগানিস্তানে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ পশতুন, ৩০ শতাংশ তাজিক, ২৩ শতাংশ হাজারা, উজবেক ও তুর্কমেন প্রায় ১৮ শতাংশ এবং বাকি অংশ আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নিয়ে। এই  মুহূর্তে প্রতিটি গোষ্ঠী সরকারি ক্ষমতার অংশ চাইবে। পশতুনরা কখনও আদমশুমারি করতে চায়নি। কারণ তাদের আশঙ্কা, যদি আদমশুমারি করা হয় তাহলে তাদের আসল সংখ্যা বেরিয়ে আসতে পারে এবং তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা  হারাতে পারে।

ইরফান: পুরনো তালেবান আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে। তারা সবাইকে নিয়ে একটি ঐক্যের সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কাজেই এ সম্পর্কে এখনই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমরা জানি না এই তালেবানরা প্রজাতন্ত্রের যুগে আবির্ভূত গণতন্ত্রে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে।

Comments

The Daily Star  | English

Khagrachhari violence: 3 dead, 4 sent to CMCH 'with bullet wounds'

Three indigenous people died of their injuries at a hospital in Khagrachhari yesterday and early today, hours after arson attacks and violence in the district

2h ago