প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুই ঘণ্টা
আমার কাছে বিষয়টি এমন যে মতবিনিময় তো দূরের কথা, ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনের ধারেকাছে যাওয়ার সুযোগই মিলল ১২ বছর পর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কখনো শীর্ষ এই ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক বা কোনো সাংবাদিককে তার কার্যালয়ে প্রবেশ কিংবা তিনি উপস্থিত থাকবেন, এমন কোনো অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের অনুমোদন দেননি। এ বিষয়টি উল্লেখের কারণ হলো, আইনগতভাবে শুধু জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট পদ ছাড়া জনগণের অর্থে পরিচালিত, সরকারি পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখা যায় না এবং এই প্রক্রিয়ার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ গণমাধ্যম। কিন্তু আমাদের এই প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জেরে সিএনএনের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতাকে বহিষ্কার করলেও ফেডারেল আদালত সেই সংবাদদাতাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুনর্বহাল করে। আদালত যুক্তি দেন, করদাতার অর্থে পরিচালিত সরকারি কার্যালয় চাইলেও গণমাধ্যমকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার রাখে না। কিন্তু এই দেশে তিনিই ছিলেন 'আইন' এবং বিচার বিভাগেও তার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল। আমরা যদি আদালতে যেতাম, তাহলে বিচারের রায় এমন হতো যে তাতে একটি অবৈধ কাজও আইনি বৈধতা পেত। আমাদের সন্দেহ সেটাই ছিল এবং নানা উদাহরণ থেকে আমরা সেরকম ইঙ্গিতই পেয়েছিলাম। ফলে, ওই ১২ বছর আমরা প্রবেশাধিকার পাইনি। অবশেষে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন। শীর্ষ বাংলা দৈনিক প্রথম আলোকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল। আমাদের একমাত্র অপরাধ ছিল, আমরা ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনতে চেয়েছিলাম।
আশা করা যায়, বাংলাদেশে চিরতরে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। অবসান হয়েছে এক-ব্যক্তির শাসন, এক ব্যক্তির ব্যাংক লুট, এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ঋণখেলাপির সংস্কৃতির—যে ব্যক্তি তার চেহারা ও বেশভূষা পাল্টে সাধু সাজার পাশাপাশি পুঁজিবাজার, বন্ডবাজার ইত্যাদি লুট করছিলেন এবং একইসঙ্গে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলাভঙ্গ করেন—এসবের। আমরা আরও আশা করছি, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাটুকারিতা, দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমেরও অবসান ঘটেছে। গত ১৫ বছরের জবাবদিহিতাহীন শাসনে এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির তালিকার যেন অন্ত নেই।
গতকাল আমরা এই নিপীড়নমূলক শাসনের অবসান হওয়ার একমাস পূর্তি উদযাপন করেছি। যখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মিলিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেয়, তা নিমিষেই একটি বিশেষ মুহূর্তে রূপ নেয়।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুই ঘণ্টার আলোচনার শুরুতেই ছিল তার ব্যাপক আন্তরিকতা। 'আমি সব কিছু জানি, আমার কথা শুনুন, ভাবুন আর করতালি দিন' এর পরিবর্তে, তিনি দ্বিধাহীনভাবে জানালেন, অনেক কঠিন একটি দায়িত্বের মুখোমুখি হয়েছেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্য খুবই কম সময় আছে তার হাতে, এ বিষয়ে তার এবং তার সহযোগীদের অভিজ্ঞতা প্রয়োজনের তুলনায় কম, সেটা উল্লেখের পাশাপাশি জানালেন, লক্ষ্য পূরণে দেশের আপামর জনসাধারণ এবং বিশেষ করে, গণমাধ্যমের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন। এ ধরনের আলোচনা আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। বিশেষত, আমরা যারা গত ১৫ বছর ক্ষমতাসীনদের সামনে সত্য প্রকাশের চেষ্টা চালিয়ে গেছি। অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। 'আমি দেশের মানুষকে ভালোবাসি এবং যখনই আমি ও আমার দল ক্ষমতায় থাকি বা থাকে, তখন তা বাংলাদেশের উপকারে আসে'—এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে সরকারের সমালোচনা করার আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়ে এটাই প্রমাণ করলেন যে, এ ধরনের মনোভাব জনগণের চাওয়া-পাওয়া পূরণে তাকে শুধু সহায়তাই করবে। এ বিষয়টি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বুঝতে না পারলেও প্রধান উপদেষ্টা ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে ড. ইউনূসের বিনয়, উদারতা এবং সর্বোপরি আন্তরিকতা আমাদের হৃদয় ও মনকে ছুঁয়ে গেছে।
সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং যে বিষয়ে তিনি আমাদের সহায়তা চেয়েছেন, তা হলো—জাতিকে একতাবদ্ধ করা। তিনি অনুভব করেছেন এবং আমরাও তার সঙ্গে একমত যে, আমরা এখন বিপজ্জনকভাবে বিভাজিত এবং শিগগির এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার। এই বিভাজনের কারণেই দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার আগের সব উদ্যোগগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তিনি যেমন বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি, তেমনি আমরাও পারিনি তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে। তবে আমরা সবাই এই সুনির্দিষ্ট সমস্যাটির গুরুত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করেছি।
সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, বিশেষত সংবিধানে সরকারপ্রধানকে কার্যত অসীম ক্ষমতা দেওয়ার যে বিষয়টি রয়েছে, তা রদ করা নিয়ে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন কমিশন (কমিশনের এক চেয়ারম্যানের ভাষায় যেটি একটি 'নখদন্তহীন বাঘ'), মানবাধিকার কমিশন ও বাকি সব সরকারি সংস্থাগুলোকে ক্ষমতায়ন করা, তাদেরকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করা, যাতে এই সংস্থাগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে—এসবও উঠে এসেছে আলোচনায়।
আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে এই সংস্থাটির ধারাবাহিক ব্যর্থতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের ধারণাকে পঙ্গু করেছে, সংসদকে অকার্যকর করেছে এবং ভোটারদের প্রতি 'পাঁচ বছরে একবার' জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগের প্রতি আস্থা হারাতে বাধ্য করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তির পর যখনই একজন আত্মসম্মানজ্ঞান ও মর্যাদা সম্পন্ন নির্বাচন কমিশনার বুঝতে পারেন যে ক্ষমতাসীন সরকার জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে, তখন স্বাভাবিক প্রত্যাশা হলো, তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারও সে পথে হাঁটেননি, যা প্রকারান্তরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক স্খলনকে প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইভাবে এসব জটিল আইনি প্রশ্ন মোকাবিলার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যাতে এটি সংবিধান ও আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বর্তমান সময়ের চাহিদাগুলো মেটাতে পারে এবং প্রধান উপদেষ্টাকে তার আগামী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে আরও স্পষ্টতা এনে দিতে পারে।
তথ্য উপদেষ্টা একটি তথ্য কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। আলোচনায় সে বিষয়টিও এসেছে এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারের কার্যক্রমকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করা হয়, যাতে সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানোর কাজে জনগণের অর্থ অপচয়ের সুযোগ না থাকে।
আলোচনার শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূসের মন্তব্যে উঠে আসে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের বিষয়টি। তিনি জানান, যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তারা সার্বিকভাবে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে: 'আপনার যতদিন সময় লাগে' এবং 'গ্রহণযোগ্য সময়সীমা নির্ধারণ করুন'। তবে গ্রহণযোগ্য সময়সীমার বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বেশিরভাগ সম্পাদকের মত হলো, অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরুতে তাদের কার্যতালিকা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে। অল্প কয়েকজন সুনির্দিষ্ট করে এক থেকে তিন বছরের সময়সীমা উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, 'মধুচন্দ্রিমার পর্যায়টি' বেশিদিন স্থায়ী নাও হতে পারে এবং অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু উপযোগিতা দেখাবেন, লক্ষ্যে স্থির থাকবেন এবং জনবান্ধব কর্মসূচি হাতে নেবেন, সে বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ধারণ করবে তাদের মেয়াদ কতদিন হতে পারে।
সম্পাদকরা উল্লেখ করেন যে মানুষের মনে এমন একটি ধারণা দানা বেঁধে উঠছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের সব সদস্য সক্রিয়তা, উপযোগিতা, মনোবল ও সৃজনশীলতা বজায় রেখে কাজ করছেন না। কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না দেখিয়ে বরং অনেকেই নিজ নিজ ডেস্কে মুখ গুঁজে বসে আছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা তাদের কাজের জটিলতা ও জনগণের বিপুল প্রত্যাশার মাত্রাকে পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারছেন না। মোট কথা তারা দৃশ্যমান নন।
সম্পাদক হিসেবে আমরা অবশ্যই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চলমান হয়রানির বিষয়ে বেশি জোর দিয়েছি। এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র প্রমাণ ছাড়াও যেভাবে হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে, সে বিষয়টির কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। এই চর্চা গণমাধ্যম ও দেশের মানুষের কাছে ভুল বার্তা দিচ্ছে এবং সারা বিশ্বের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।
গণমাধ্যম ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলতে গেলে দেড় দশকের দমন-পীড়ন, হয়রানি, ভিত্তিহীন সন্দেহ ও দুর্বৃত্তায়নের পর নিঃসন্দেহে এটি একটি স্বস্তিদায়ক ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব নৈতিকতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার রীতিনীতি বর্জন করে এ সম্প্রদায়েরই একটি শ্রেণি এতদিন বিপরীত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাদের এসব উদ্যোগ সব সাংবাদিকের লজ্জার কারণ।
অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রাথমিকভাবে দুইটি মূলধারার কাজে নিয়োজিত হতে হবে: একটি হলো—দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা। অপরটি হলো—এর সংস্কার করা। প্রথমটি একটি সুবিশাল কর্মযজ্ঞ এবং এর পেছনেই যেকোনো দেশের পূর্ণাঙ্গ ও নির্বাচিত সরকারের উদ্যম ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হতে পারে। এক্ষেত্রে কাজটিকে আরও জটিল করে তুলেছে উৎখাত হওয়া সাবেক সরকারের রেখে যাওয়া অন্যায্যতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির নজির এবং সুশাসনের অভাব।
দ্বিতীয় কাজটি হলো একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগকে কাজে লাগানো। আমরা যে কেউ অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে এক মিনিট চিন্তা করলেই বুঝতে পারব, অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে কত বড় একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
আসুন আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করি। সময় দিই, ধৈর্যশীল হই, তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের ওপর ভরসা রাখি।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments