আফগানিস্তানে তালেবান, সংকটে ভারত

প্রায় ২০ বছর পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে চলে আসায় দেশটিতে ভারতের স্বার্থ ‘চরম সংকটে’ পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেয় ভারত। ছবি: রয়টার্স

প্রায় ২০ বছর পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে চলে আসায় দেশটিতে ভারতের স্বার্থ 'চরম সংকটে' পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গতকাল রোববার কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

গবেষকদের মতে, গত ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবান নেওয়ার পর সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারতের কূটনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। এখন আফগানিস্তানে 'সবচেয়ে সংকটে' থাকা দেশগুলোর তালিকায় আছে ভারতের নাম।

তালেবান কাবুল ঘিরে ফেলার পরপরই নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে চলে যান। হঠাৎ পশ্চিমের সমর্থনপুষ্ট কাবুল সরকারের পতনের হলে তালেবানের ভয়ে কূটনীতিক, বিদেশি দাতা সংস্থার কর্মী ও তাদের সহযোগী আফগানদের মধ্যে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। এর মধ্যে ভারতীয়রাও রয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আফগানিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ

তালেবান-পূর্ববর্তী আফগান সরকারের সঙ্গে যেসব দেশ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত তাদের অন্যতম। গত ২০ বছরে আফগানিস্তানের উন্নয়নে ভারত প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়াও রয়েছে আফগান শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া।

বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ভারত ৯০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন তৈরি করে দিয়েছে।

গত বছর 'আফগানিস্তান সম্মেলনে' ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শংকর বলেছিলেন, ভারতের নেওয়া ৪০০-এর বেশি প্রকল্পের মাধ্যমে আফগানিস্তানের সর্বত্র তথা ৩৪টি প্রদেশেই উন্নয়ন কাজ করা হবে। দেশটির কোনো এলাকাই উন্নয়নের বাইরে থাকবে না।

শুধু উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকেও বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বন্ধুপ্রতীম দেশ দুটি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ভারত-আফগানিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দেড় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।

তালেবানকে ভারত তার চির শক্র পাকিস্তানের 'প্রতিনিধি' মনে করে। তাই তারা আফগানিস্তানে তালেনবানবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। আমেরিকা-ন্যাটো বাহিনীর সহযোগিতায় এই উত্তরাঞ্চলীয় জোট ২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক উইলসন সেন্টার'র এশিয়া প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক মিশেল কুগেলমান গণমাধ্যমকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক সহযোগী ভারত এখন সেখানে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে।'

একই ধারণা পোষণ করেন নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাপিমন জ্যাকব। তিনি বলেন, 'আমার মনে হয়, আফগানিস্তান থেকে ভারত এখন বিতাড়িত।'

তার মতে, গত ২০ বছর আফগানিস্তানে ভারত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু, বর্তমানে সেখানে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান প্রায় 'শূন্য'। এই অবস্থা দিনে দিনে ভারতের জন্যে 'নাটকীয়ভাবে আরও শোচনীয়' হয়ে উঠছে।

আফগানিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন। ছবি: রয়টার্স

'অনেক দেরি হয়ে গেছে'

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়ে ভারত 'অনেক দেরি' করে ফেলেছে।

গণমাধ্যমে বলা হয়, গত জুনে ভারতীয় কর্মকর্তারা কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অথচ, দোহায় তালেবান রাজনৈতিক কার্যালয় খুলেছে ২০১৩ সালে।

উইলসন সেন্টার'র মিশেল কুগেলমান বলেন, তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়ে নয়াদিল্লির পিছিয়ে পড়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে— তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের অনীহা এবং অন্যটি হচ্ছে 'আফগান শান্তি প্রক্রিয়া' ভেস্তে যাওয়া। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তির পর 'আফগান শান্তি প্রক্রিয়া' শুরু হয়েছিল।

একদিকে, ভারতের অভিযোগ তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'য়ের সম্পৃক্ততা আছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের অভিযোগ ভারত আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে 'সন্ত্রাসী হামলা' চালাচ্ছে।

কুগেলমান মনে করেন, তালেবান আবার ক্ষমতায় আসায় তা ভারতের কৌশলগত স্বার্থে ব্যাপক আঘাত হেনেছে।

তিনি বলেন, 'আফগানিস্তানে এখন পাকিস্তানপন্থি সরকার আসবে। এটি পাকিস্তান ও এর ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের জন্যে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই দেশ দুটিকেই ভারত তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।

'কাবুলে তালেবান ক্ষমতায় আসায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, এটি ভারতবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নতুনভাবে চাঙা করতে পারে,' যোগ করেন তিনি।

'অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণনীতি'

কাবুলে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত থাকা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র তিনটি দেশ— পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

কিন্তু, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। কেননা, আঞ্চলিক শক্তি চীন, রাশিয়া ও ইরান নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষায় তালেবানের সঙ্গে কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছে।

গত সপ্তাহে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তালেবান 'দায়িত্বশীল সরকার' হিসেবে কাজ করলে নয়াদিল্লির উচিত হবে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা।

কিন্তু, আফগানিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেছেন, পরিস্থিতি এখনো পরিবর্তনশীল এবং কোনকিছুই পরিষ্কার নয়।

আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, 'আমরা আফগানিস্তানে এখনো কোনো অন্তর্বর্তী সরকার দেখছি না। আমেরিকা-ইউরোপ সমর্থিত আফগান সরকার এখনো জাতিসংঘের স্বীকৃত সরকার। আমি মনে করি, আমাদের অপেক্ষা ও ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'

উইলসন সেন্টার'র কুগেলমানের মতে, ভারতের হাতে এখন একটি সুযোগই আছে আর তা হলো তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা।

তিনি বলেন, 'নয়াদিল্লি নিদেনপক্ষে তালেবান সরকারের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখতে পারে। যাতে করে আফগানিস্তানে তার বিনিয়োগ নষ্ট না হয়ে যায়।'

Comments

The Daily Star  | English

Where should I invest my money?

Amid persistently higher inflation in Bangladesh for more than a year, the low- and middle-income groups are struggling to meet their daily expenses.

13h ago