জ্যোতি বসু: প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির খতিয়ান
বিশ শতকের ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বর্ণময় চরিত্র হলেন জ্যোতি বসু। প্রায় শতাব্দীকাল তার রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহমানতা কেবল ভারতীয় রাজনীতিতেই একটা মাত্রা যোগ করেনি, দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বামপন্থী চেতনার বিকাশে তার অবদান ঐতিহাসিক। জওহরলাল নেহেরুর পর ভারতে জ্যোতি বসুর মতো যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক আর কেউ ছিলেন না। সুবিধাবাদের আশ্রয় নিয়ে, নিজের দলকে সংসদীয় রাজনীতিতে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার তাগিদে জ্যোতিবাবু তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি।
জরুরি অবস্থার আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস বামফ্রন্ট তৈরির পটভূমিকা নির্মাণ করেছিল সেটি সংসদীয় রাজনীতিতে জ্যোতি বসুকে এক উজ্জ্বল দীপ্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ষাটের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকার চালানোর অভিজ্ঞতার নিরিখে জর্জি ডিমিট্রভের তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের দিকটা প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। অজয় মুখার্জীর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে একক বৃহত্তম দল হয়েও মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবি সেই সময়ে সিপিআই (এম) কখনোই জানায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর পদটি সিপিআই (এম) না নিলেও স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজেদের হাতে থাকায় তাদের কাজকর্ম ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সঙ্গে ক্রমেই সংঘাত তৈরি হচ্ছিল জ্যোতি বসুর। হরেকৃষ্ণ কোঙারের উত্তেজক বক্তৃতাগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণি অবস্থানে থাকা অজয়বাবু বা তার সঙ্গী-সাথীদের পক্ষে হজম করাটা খুব মুশকিলের বিষয় হয়ে উঠছিল। সেই পরিস্থিতিতে বাম আন্দোলনকে ধ্বংস করবার তাগিদেই সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনীতি ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করছিল। যুক্তফ্রন্টের ভূমিনীতিকে ভুলভাবে উপস্থাপনা করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে জ্যোতি বসুর প্রশাসনিক অপদার্থতা দেখাবার যে প্রচেষ্টা সঙ্কীর্ণতাবাদীরা এইসময় থেকেই দেখাতে শুরু করে তার পিছনে কেবল কংগ্রেস নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে কমিউনিস্টবিরোধী শক্তি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খুব বড় একটা ভূমিকা ছিল।
এই পটভূমিকা ছয়ের দশকে দুটি পর্যায়ের যুক্তফ্রন্ট সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বামপন্থী দলগুলোকেই ঋদ্ধ করেছিল। এসইউসিআই নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করলেও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বাম দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্যায়েই যুক্তফ্রন্ট সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের বোঝাপড়াটার ভিত্তিটা খুব সুখপ্রদ ছিল না। কুলতলির ওসির মৃতদেহ নিয়ে পুলিশের যে মিছিলটি জ্যোতিবাবুকে হেনস্থার উদ্দেশে সেদিন বিধানসভা ভবনে এসেছিল- সেই মিছিলের প্রতি কংগ্রেসের মতোই এসইউসিআইরও ছিল প্রচ্ছন্ন মদত।
সেই পটভূমিকায় জরুরি অবস্থার অবসানের সময়কালে বামফ্রন্ট তৈরির ক্ষেত্রে প্রমোদ দাশগুপ্তের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। যে ফরোয়ার্ড ব্লক হেমন্ত বসু হত্যায় সিপিআই (এম) কে দায়ী করে কার্যত হত্যাকারীদের ধরবার বিষয়টিতেই জল ঢেলে দিয়েছিল, সেই ফরোয়ার্ড ব্লককেও বামফ্রন্টে ব্রাত্য করে রাখেননি প্রমোদবাবু, জ্যোতিবাবুরা। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার শপথ নেওয়ার পর আরএসপির মন্ত্রীরা শপথ নিয়েও মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন পছন্দের দপ্তর না পেয়ে। এই ক্ষেত্রেও জ্যোতিবাবু এবং প্রমোদবাবু, নিজেদের দলের একক ক্ষমতার দোহাই নিয়ে কখনো কোনো আত্মতৃপ্তিতে ভোগেননি। শরিক দলগুলোকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে বসু, দাশগুপ্তের ভিতরে কখনো কোনোরকম সঙ্কীর্ণ চিন্তার প্রকাশ বা প্রয়োগ দেখা যায়নি।
জরুরি অবস্থার সময়কালের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা চরম কমিউনিস্টবিরোধী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং বামপন্থীদের কিছুটা কাছাকাছি এনেছিল। সেই নৈকট্যের ভিত্তিতে ’৭৭ এর বিধানসভা ভোটের আগে বামফ্রন্টের সঙ্গে জনতা পার্টির একটা নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। সেই সমঝোতা প্রফুল্ল সেনের একগুয়ে মনোভাবের জন্যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হলে মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে একটা সঙ্কট যে নতুন করে তৈরি হতো সেই কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পর সেই সরকারে প্রবীণ-নবীনের এক মেলবন্ধন দেখতে পাওয়া গেল। জ্যোতি বসুর মতো সংসদীয় রাজনীতিতে দক্ষ মানুষের সঙ্গেই দেখা গেল নবীন প্রজন্মের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। দেখা গেল পোড় খাওয়া শ্রমিক নেতা কৃষ্ণপদ ঘোষকে। কৃষক আন্দোলনে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া বিনয় চৌধুরী, প্রভাস রায়কে। আরএসপি দলের পক্ষ থেকে এলেন চা শ্রমিক আন্দোলনের পোড় খাওয়া ব্যক্তিত্ব ননী ভট্টাচার্য, যতীন চক্রবর্তী, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ড. অশোক মিত্র, অমৃতেন্দু মুখার্জী, প্রশান্ত শূর, নিরুপমা চ্যাটার্জী, কমল গুহ, কানাইলাল ভট্টাচার্য, শম্ভু ঘোষেরা একটা নতুন আশার সঞ্চার করলেন সাধারণ মানুষের ভিতরে।
ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বাবু ছয়ের দশকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়কালের অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রবল দ্বিধান্বিত ছিলেন যে, তাদের সরকার কে পাঁচ বছর চলতে দেওয়া হবে কি না সেই সম্পর্কে। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসার পর সরকারের স্থায়িত্ব সম্পর্কে বামপন্থী নেতৃত্ব আরও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এই দ্বিধান্বিত পরিবেশের ভিতরেই অনেক সীমাবদ্ধতার ভিতরেও বামফ্রন্টের সব থেকে উল্লেখযোগ্য এই সময়ের কাজ ছিল, রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশের একটা উপরিকাঠামোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ‘উপরিকাঠামো’ শব্দটি এই কারণে ব্যবহার করা হলো যে, কংগ্রেস যেভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করে নিজেদের দলের হাতেই কার্যত প্রশাসনকে তুলে দিয়েছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বদান্যতায়, সেই পথে প্রথম অবস্থাতে বামফ্রন্ট কখনোই হাঁটেনি। তবে গ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করবার মানসিকতায় পঞ্চায়েতের ভোট বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক কীর্তি। যদিও অচিরেই শ্রেণি অবস্থানে বিপরীত শিবিরের মানুষজন যে পোষাক বদলে বামপন্থী ভেক ধরে বামফ্রন্টের দলগুলোতে ভিড়ে যাচ্ছে—এই বন্যার প্রাদুর্ভাবে বাঁধ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বামফ্রন্টের কোনো দলই দেখেনি।
ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসার পর প্রথম ও দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার অর্থনীতি ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে যে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল—সেটি ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় সংবিধান প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বজায় রাখবার প্রশ্নে স্বাধীনতার পর প্রথম লড়াই ছিল। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করে রাজ্যগুলোকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে কমজোরি করবার যে জরুরি অবস্থা উত্তর স্বৈরাচারী মানসিকতার নতুন প্রকাশ শ্রীমতী গান্ধী ঘটিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা দেশে জনমত তৈরির ক্ষেত্রে সেদিন বামফ্রন্ট সরকার, জ্যোতি বসু-অশোক মিত্রেরা এক ঐতিহাসিক দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। এই পর্যায়টিই পরবর্তীকালে কেন্দ্রে অকংগ্রেসী সরকার (বিজেপি) কে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।
এই সময়কালে বামফ্রন্টের সাফল্যের আর একটি বড় দিক হলো স্থানীয় প্রশাসনগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে পৌরসভা এবং পঞ্চায়েত পরিচালনার ভার ন্যস্ত হওয়ার ফলে প্রথম অবস্থায় কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলো যদেষ্ট পর্যুদস্ত হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে নতুন করে যে স্বার্থান্বেষী মহলো তৈরি হলো—সেই মহলে শাসকের অনুগ্রহভাজনদেরই হাতযশ প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করল—এই বিষয়টি কিন্তু না প্রশাসনিক ভাবে গুরুত্ব দিয়ে বামফ্রন্ট দেখেছে, না রাজনৈতিকভাবে দেখেছে।
এই পর্যায়ে সেইসময় থেকেই আরও একটি বড় সমস্যার বীজ পোঁতা হয়েছিল। সেটি হলো; একটা বড়ো অংশের নিজেদের লোককে চাকরি পাইয়ে দেওয়া। পৌরসভা এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করলো যা বামপন্থীদের কাছে কোনো অবস্থাতেই অভিপ্রেত ছিল না। রাজনৈতিকভাবে নির্যাতন ভোগীকারীদের চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রটিও সমুচিত গুরুত্ব পেল না। গুরুত্ব পেল একটা বড় অংশের স্থানীয় নেতাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি। রাজনৈতিক আনুগত্য, আদর্শগত আনুগত্যের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল ব্যক্তি আনুগত্য। নেতার প্রতি দাস্য মানসিকতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠল আর্থিক অস্বচ্চতারও। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের সঙ্গেই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নারী প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে যৌন হেনস্থারও অভিযোগ যে ওঠেনি তা নয়। উদাহরণ হিসেবে উত্তর চব্বিশ পরগণার বিশিষ্ট শিক্ষক নেতা তথা একটা সময়ে অত্যন্ত ক্ষমতাবান শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ এর সহ সভাপতি গৌরীশঙ্কর বসুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা বলা যেতে পারে। কোনো ক্ষেত্রেই এই ধরনের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখায়নি বামপন্থী নেতৃত্ব। ফলে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় প্রশাসন বা স্কুলগুলোতে বামপন্থীদের সংগঠনগুলো একদম তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে শুরু করে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্যে যেমন বামফ্রন্ট সরকার বাংলার সামাজিক ইতিহাসে একটা বিশিষ্ট জায়গা নিয়ে থাকবে, তেমনি বামফ্রন্টের ভিতরেই একটা অংশের নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থে যেভাবে ক্ষমতার অলিন্দ্যকে ব্যবহার করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশেরও সুযোগ থেকে যাবে। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সুভাষ চক্রবর্তী, লক্ষণ শেঠ, সুশান্ত ঘোষ, অনিল বসু, তড়িৎবরণ তোপদার, নেপালদেব ভট্টাচার্য, কমল গুহ, ক্ষিতি গোস্বামী, নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, কলিমুদ্দিন শামস প্রমুখের নাম ঘুরে ফিরে আসবে।
বামফ্রন্ট সরকারের জনভিত্তিকে সাধারণ মানুষের কাছে অপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) দলের ভিতর নিজে এবং নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের আধিপত্যবাদ কায়েমের প্রশ্নে সুভাষ চক্রবর্তীর একটি বিশিষ্ট্য ভূমিকা আছে। আর সেই ভূমিকা পালনে সুভাষের প্রতি প্রচ্ছন্ন মদতের প্রশ্নে খোদ জ্যোতি বাবুর ভূমিকাটিকেও কোনো অবস্থাতেই আমরা অস্বীকার করতে পারি না। প্রমোদ দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর দলীয় রাজনীতিতে শিবির বদল করেন একদা ‘প্রমোদ দাশগুপ্তের ঢাল’ বলে পরিচিত সুভাষ চক্রবর্তী। তবে প্রমোদ দাশগুপ্তের জীবিত অবস্থাতেও প্রমোদ বাবুর বিশেষ ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করা সুভাষ চক্রবর্তীকে স্বয়ং প্রমোদবাবু নিজে কতোটা ভরসা করতেন তা নিয়ে একটা সংশয় থেকেই যায়। সুধাংশু দাশগুপ্ত একটা সময়ে সুভাষকে অবিভক্ত উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সিপিআই (এম) এর সম্পাদক করার মৌখিক পরামর্শ প্রমোদ বাবুকে দেন। সেই পরামর্শে কর্ণপাতই করেননি প্রমোদবাবু। অনুমান করা যায় যে, পরবর্তী সময়ে যে ধরনের সমস্যাগুলো সুভাষ চক্রবর্তীকে ঘিরে প্রবল হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে একটা আগাম অনুমান প্রমোদ দাশগুপ্তের ছিল। সেই কারণেই নিজের পছন্দের সুভাষের উপর বিশেষ আস্থা রাখেননি প্রমোদবাবু।
সুভাষের মানসিকতা সম্পন্ন মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী, সমর্থক—যাদের কাছে ক্ষমতার আস্ফালনই ছিল রাজনীতির প্রধান উপজীব্য, তারাই বামফ্রন্ট সরকার এবং বামফ্রন্ট ভুক্ত দলগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রয়োগজনিত ক্ষেত্রে একদম বিপরীতমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সুভাষ চক্রবর্তীর কাছে দলের বিপক্ষ গোষ্ঠীর নেতারা ছিলেন বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের থেকেও খারাপ। সুভাষের গোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, সমর্থকদের একমাত্র কাজ ছিল অপর গোষ্ঠীর মানুষদের সবরকম ভাবে হেনস্থা করা। সেই হেনস্থাতে যদি বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সুবিধাও হয়ে যায়, বামফ্রন্ট সরকার বা দলের ক্ষতিও হয়ে যায়—সেগুলো কোনো অবস্থাতেই সুভাষ চক্রবর্তী বা তার একান্ত কাছের লোক শ্যামল চক্রবর্তী, গৌতম দেবদের কিছু যেত আসত না। ক্ষিতি গোস্বামী, নন্দগোপাল ভট্টাচার্যেরা বামফ্রন্ট সরকারের ভিতরেও যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যবিরোধী ব্লক চালাতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলতেন, সেইসবের পিছনেও সুভাষ বা তার ঘনিষ্ঠদের ভয়ঙ্কর বুদ্ধদেববিরোধী মানসিকতাজনিত প্রশ্রয় থাকার রটনাকে একদম অস্বীকার করতে পারা যায় না।
এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে বামফ্রন্টের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রধান ঘটনাপ্রবাহগুলোও। নন্দীগ্রামে গুলি চালনার ঘটনাক্রমের পিছনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কালিমা লেপন করবার মতো কোনো বিষয় বুদ্ধবাবুর দলের ভিতরেই একটা অংশের ভিতরে ছিল না তো? বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকার ফলে একটা বঢ় অংশের বামপন্থীদের করে কম্মে খাওয়ার সমস্যা হচ্ছিল। এই অংশের মানুষ যেমন সিপিআই (এম) এর ভিতরে ছিলেন, তেমনি ছিলেন আরএসপি, সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক ইত্যাদিদের ভিতরেও। নয়াচরে কেমিকাল হাব নিয়ে রাজ্য সরকার কোনো আলাপ আলোচনাই করেনি অথচ পঞ্চায়েত অফিস থেকে হাবের জন্যে জমি অধিগ্রহণের বার্তাবাহী বিজ্ঞপ্তি জারি হলো, আর সেই কান্ডের ভিতরে লক্ষণ শেঠের কোনো ভৃমিকা নেই—এটি কি কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসযোগ্য? রাজনীতির ক্ষেত্রে লক্ষণ শেঠ সিপিআই (এম) দলে যাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সেই সময়ে, তাদের ওই বিজ্ঞপ্তি লটকানো ঘিরে কোনো ভূমিকা ছিল না—এটা একজন বাচ্চা ছেলেও বিশ্বাস করতে পারবে না।
জ্যোতি বসু ধ্রুপদীয়ানার বামপন্থার সঙ্গে বাস্তবতার যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন—সেটিই ছিল তার অনন্যতার সবথেকে বড়ো চাবিকাঠি। আশ্চর্যজনক সমন্বয়ী চেতনা ছিল জ্যোতি বসুর। রাজনৈতিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সব ধরনের সংখ্যালঘুর অভিমতকে গুরুত্ব দিয়ে চলা ছিল জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের সব থেকে বড় লক্ষণ। বামফ্রন্টের ভিতরে যে দলটি খুবই ছোট, হয়তো সিপিআই (এম) এর সাহায্য ছাড়া পৌরসভাতেও একটা আসন জিততে পারবে না যে শরিক দল, তাকেও তার যোগ্য মর্যাদা দিতেন জ্যোতিবাবু। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যে বিশ্বের রাজনীতিতে জর্জি ডিমিট্রভের তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাস্বর হয়ে থাকবেন জ্যোতি বসু।
গৌতম রায়, ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
Comments