ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ২১০০ কোটি টাকা লোপাট

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গ্রাহকদের জমা দেওয়া টাকা থেকে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অর্থ লোপাটের বিষয়টি উঠে এসেছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গ্রাহকদের জমা দেওয়া টাকা থেকে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অর্থ লোপাটের বিষয়টি উঠে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের বীমার আবেদন নিষ্পত্তি করছে না ও মেয়াদ পূর্ণ হওয়া পলিসি মালিকদের তাদের টাকা বুঝিয়ে দিতে পারছে না এরকম অভিযোগের ভিত্তিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই অডিট করে।

এ ওয়াহাব অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস থেকে নিরীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিএসইসি আগস্ট মাসে ফারইস্ট লাইফের বোর্ডকে পুনর্গঠন করে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় ১০ জন।

কমিশন ইতোমধ্যে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, তাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানকে ফারইস্ট ইনস্যুরেন্সে ও অন্যান্য তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের শেয়ারের লেনদেন করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার নির্দেশ দিয়েছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের পরিচালকরা জমি কেনার ক্ষেত্রে দাম নিয়ে কারসাজি, নিজেদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও প্রতারণামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠানে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে দেখিয়ে তহবিল তছরুপ করেছেন বলে এই বিশেষ নিরীক্ষা থেকে জানা গেছে।

২৪ নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বিএসইসি জানায়, এটি খুবই পরিষ্কার যে বীমা প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে জমি কিনেছিল। এই ঘটনার সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ বেশ কিছু পরিচালক জড়িত ছিলেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

বিএসইসি পরিচালক রিপন কুমার দেবনাথের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, 'গত এক দশকের বিভিন্ন সময়ে ৮৫৮ কোটি টাকার পুঁজি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।'

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে বীমা প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের শ্যালক ও শ্বশুরের কাছ থেকে ১৭২ কোটি টাকার বিনিময়ে ২৮ শতাংশ জমি কেনে। তারা দুজন এই জমিটি একই বছরে মাত্র ১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন।

অডিট থেকে জানা গেছে, নজরুলের স্ত্রী পরবর্তীতে তার ভাই ও বাবার কাছ থেকে ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে ১১৫ কোটি টাকা পেয়েছেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ফারইস্ট দুইটি সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এবং সমিতিগুলোকে ১৯১ কোটি টাকার অগ্রিম অর্থ প্রদান করে করে।

প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক হিসাবে দুইটি সমবায়ের কাছে অগ্রিম টাকা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা যায়নি।

'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, ২০১৬ সালে একটি সমবায় সমিতি বন্ধ হয়ে যায় এবং এই টাকার কোনো হিসেব খুঁজে পাওয়া যায়নি', চিঠিতে বলা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্পোরেট অর্থ পাচারের প্রতারণায় সহায়ক উপকরণ হিসেবে এই দুটি সমবায় সমিতিকে ব্যবহার করা হয়েছে।

বীমা প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালের ব্যালেন্স শিটে পুঁজিবাজারে ও বন্ডে বিনিয়োগ হিসেবে ৬৮৬ কোটি টাকার হিসাব দেখানো হয়েছে।

বিএসইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফার ইস্টের কর্পোরেট বুক অব অ্যাকাউন্ট নিবিড় ভাবে নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকা জমা রেখেছে, বোর্ড মিটিং এর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জাল করেছে এবং সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩ জন স্পন্সর-পরিচালক ও তাদের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

যখন এই ১৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন ব্যাংকগুলো ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের জমা দেওয়া টাকা তরলীকরণ করতে বাধ্য হয়।

চিঠিতে বলা হয়, এসব বেআইনি লেনদেনের মাধ্যমে ফারইস্ট ইনস্যুরেন্সের ৬৫৯ কোটি টাকা পাচার করা হয়।

সুনির্দিষ্টভাবে নজরুল ইসলাম, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্লাহ ও স্পন্সর-পরিচালক এম এ খালেককে এর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং তারাই এর বাস্তবায়ন ঘটিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের সম্পদ পাচার করেন বলে ধারণা করা হয়।

বীমা প্রতিষ্ঠানটি একাধিক ব্যাংকে ২০১৩ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে ৩৬৯ কোটি টাকা জমা রাখে। এই 'টার্ম ডিপোজিটের' লিয়েনের বিপরীতে খালেক ৩১২ কোটি টাকা ঋণ নেন, যেটি পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যায়।

এ ঘটনার পর ব্যাংকগুলো ফার ইস্টের কর্পোরেট টার্ম ডিপোজিটগুলোর তরলীকরণ করে এবং সে অনুযায়ী ফারইস্ট ইসলামী ইনস্যুরেন্সের হিসাবপত্রে উল্লেখ করা হয়, খালেকের কাছে ঋণ ও বিনিয়োগ বাবদ ৪২১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, খালেক বীমা সংস্থাটির সঙ্গে ২০১৮ সালে সমঝোতা করেন এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তার ৩৬৯ কোটি টাকার দায় মেনে নেন।

বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, 'এটি নিশ্চিত যে মো. নজরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেখানে ধারাবাহিকভাবে আর্থিক অপরাধ ও অর্থ পাচার সংঘটিত হয়েছে।'

আরও বলা হয়, অডিট কমিটি প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, যে কারণে প্রতিষ্ঠানের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি।

ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্যদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া, কিন্তু কমিশনের পাওয়া তথ্য প্রমাণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্যরা বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব দুর্নীতিতে অংশ নিয়েছেন।

'এটি খুবই সম্ভব যে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সম্পদকে নিজেদের ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য ব্যবহার করেছেন।'

বিএসইসির চিঠি অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে চারটি নিরপেক্ষ অডিট প্রতিষ্ঠান ফারইস্টের আর্থিক অডিট করেছে এবং অপর তিনটি প্রতিষ্ঠান কর্পোরেট সুশাসন সংক্রান্ত অডিট করেছে।

তারা এই বড় আকারের প্রতারণা ও মানি লন্ডারিং সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার জন্য ভবিষ্যতে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্বাহী পরিচালক শাকিল আখতার বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড এবং ব্যবস্থাপনা পরিষদ সম্মিলিতভাবে এই প্রতারণায় অংশ নিয়েছে, তাই আমরা তাদেরকে আগে থামাতে পারিনি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা সাধারণত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ দেই এবং আশা করি বোর্ড থেকে কোনো ধরনের অবৈধ দাবি আসলে তিনি তা আমাদেরকে জানাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিষদ আমাদেরকে কিছু জানায়নি। যখন বীমা সংস্থাটি গ্রাহকের বীমা দাবি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা আমাদের কাছে অভিযোগ জানায় এবং আমরা জানতে পারি প্রতিষ্ঠানটি বিপদে আছে।'

তিনি জানান, এ ধরনের দুর্নীতি থামানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদ আইডিআরএকে এ বিষয়ে না জানায়।

দ্য ডেইলি স্টার নজরুল, হেমায়েত ও খালেকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত তারা কেউ সাড়া দেননি।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব মাহমুদুল হাসান বলেন, 'দুর্নীতির ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও আমরা এখন ধীরে ধীরে গ্রাহকদের বীমার দাবি মেটাচ্ছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা জানি একটি নিরপেক্ষ অডিটর প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার অডিট করছে এবং বিএসইসিও তদন্তের জন্য কাগজপত্র চেয়েছে। আমরা বিএসইসিকে তাদের তদন্তে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।'

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাদের কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে এবং দুর্নীতির বিস্তারিত জানা গেছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।

তিনি জানান, মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএর এ দুর্নীতির বিষয়টি খুঁজে বের করা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, 'কিন্তু তারা এটি করেনি। শেয়ারহোল্ডার, পলিসিহোল্ডার ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা এটি করেছি। এখন আইডিআরএ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও দুদক এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

EVMs, the EC, and waste of public money

Why did the EVM experiment fall on its face?

10h ago