‘একটা জীবন চলে যাচ্ছে, কিন্তু সুখ দেখলাম না!’

ফাতেমা বেগম। ছবি: স্টার

অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সেই সংসারে বাবা স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে সন্তান হবে। বড় হয়ে সংসারে সাহায্য করবে। কিন্তু ছেলের আশায় বারবার সন্তান নিলেও মেয়ে সন্তানই পৃথিবীতে আসে। আর মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় বাবা ফেলে এসেছিলেন নদীর কাছে। সন্তানকে নিয়ে বাবাকে বেরিয়ে যেতে দেখে দাদির সন্দেহ হয়। পরে তিনিই উদ্ধার করেন এবং নিজের কাছে রেখে বড় করেন, বলছিলেন অটোরিকশা চালক ফাতেমা বেগম।

জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে শুধু বাধা-ই পেয়েছেন। একটু ভালো থাকার আশায় মানুষের বাড়িতে কাজ করা থেকে তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন। কিন্তু ভালো থাকতে পারেননি। মাঝপথে স্বামীর কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, চিকিৎসার পেছনে খরচ করে এখনও ঋণের বোঝা বইছেন। পরিবার থেকে সমাজে-নানা কটূ কথা আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। তবে দমে যাননি, জীবনযুদ্ধে হার মানেননি। শারীরিক অসুস্থতা আর অভাবকে হার মানাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে পথে নেমেছেন ফাতেমা।

ফাতেমা বেগম। ছবি: স্টার

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ি মোড়ে কথা হয় ফাতেমার সঙ্গে। নোয়াখালীর চর আলেকজান্ডারে জন্ম। বয়স ঠিক কত, তা নিশ্চিত করতে না পারলেও বিশ পার হয়েছে বলে অনুমান করেন।

ফাতেমা জানান, তারা ছয় বোন ও এক ভাই। তিনি সবার ছোট।

ফাতেমা বেগম বলেন, 'যহন আমার চার বছর, তখন দাদি আমারে ঢাকায় নিয়া আসে। পরিচিত একজনের বাসায় কাজ করতে দ্যায়। তহন তো আমি ছোড, বয়স কম, সুযোগ পাইলেই খেলতে যাইতাম। এই নিয়া যে বাসায় কাজ করতাম তারা আমারে মারধর করত। ছোড ছিলাম, খেলার নেশাই বেশি ছিল। অতো কিছু তো বুঝতাম না। একটু বড় হওয়ার পর বাসায় কাজ বাদ দিয়া গার্মেন্টেসের চাকরিতে ঢুকলাম।'

ভেবেছিলেন তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। কিন্তু বাধা হয়ে আসে লাভলু সরকার নামের এক রিকশাচালক। জোর করে তাকে বিয়ে করে।

২০২০ সালের এপ্রিলে ফাতেমা অন্তঃসত্ত্বা হন। সেসময়ই খবর পান তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে। তিনি বলেন, 'আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। পরে খোঁজ নিয়া দেহি, সত্যিই বিয়া করছে।'

খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারেন, একটা নয়, তার স্বামী ১৫টির মতো বিয়ে করেছে।

বিয়ের পর যত দিন তারে আমি টেকা দিতে পারছি ততদিন আমি ওর (স্বামী) কাছে ভালা ছিলাম। যখন আর দিতে পারি নাই, তখন আমি খারাপ অইয়া (হয়ে) গেলাম। আমাকে মারধর করতে শুরু করল,' যোগ করেন ফাতেমা।

তিনি জানান, স্বামী খোঁজ নেওয়া বন্ধ করলে তিনি আর কোনো উপায় না পেয়ে প্যাডেলচালিত রিকশা চালানো শুরু করেন। আর এই কারণে গর্ভের সন্তানের সমস্যা হয়।

সন্তানের কথা বলার সময় চোখ দুটো ছলছল করছিল ফাতেমার। গর্ভে তার ছেলে সন্তান ছিল। কিন্তু সন্তানের হাসি দেখার আগেই তার মৃত্যু হয়।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ফাতেমা বলেন, 'আমার ছেলে মৃত হইছে কারণ, ও যখন পেটে আছিল তখন আমারে ভারী কাজ করতে হইছে। ডাক্তার কইছে, ওই কারণে ছেলে মারা গেছে। পোড়া কপাল আমার।'

এ সময় চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেন না। গলায় থাকা গামছা দিয়ে চোখের পানি আড়ালের চেষ্টা করেন। আর জানান, সন্তান জন্মের পর তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে যান। প্রায় এক মাস তাকে তার জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে। চিকিৎসার পেছনে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ টাকা ঋণ করতে হয়। সেই টাকা এখনও পুরোটা পরিশোধ করতে পারেননি। অটোরিকশা চালিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার টাকা দেনা শোধ করেছেন।

ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে কোনোদিন ২০০ টাকা, আবার কোনোদিন ৩০০/৪০০ টাকাও আয় হয়। বর্তমানে গাবতলী এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকেন ফাতেমা।

তিনি বলেন, 'ছোডবেলায় অনাদর-অবহেলায় বড় হইছি। স্বামীর সংসার করলাম, সেখানেও সুখ কি জিনিস তা আমি চোখে দেহি নাই। একটা জীবন চলে যাচ্ছে, কিন্তু সুখ দেখলাম না!'

'বাবা-মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের কারো সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। স্বামী নতুন বিয়ের পর আমারে ডিভোর্সও দেয় নাই। আবার আমার খোঁজও নেয় না,' যোগ করেন তিনি।

ফাতেমা বলেন, 'আমি ছেলেদের শার্ট পরে রিকশা চালাই। যে যাই বলুক, কেউ তো আর আমারে এক বেলা ভাত দিয়া যাইব না। সব চোখ বুঝে সহ্য করি। নিজের আয়ের পথ নিজেরেই খুঁজতে হইব।'

তিনি বলেন, 'আগে প্যাডেলের রিকশা চালাইতাম। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেইকা আগের মতো শক্তি নাই শরীলে। তাই অটোরিকশা চালাই। কি করব কন, কিছু একটা তো করতে হইব।'

নারী হয়ে অটোরিকশা চালানোর কারণে মানুষের কাছ থেকে নানা ধরনের কথা শুনতে হয় বলে জানান ফাতেমা। যাত্রী পেতেও সমস্যা হয়। আবার যাত্রীদের কেউ কেউ ভাড়াও কম দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই রিকশা চালান।

এখনো দেনা রয়েছে ৪০ হাজার টাকা। সেই ঋণ শোধ হলে তিনি গ্রামে ফিরে যাবেন।

ফাতেমা বলেন, 'আমার ইচ্ছে ওই ৪০ হাজার টাকার ঋণ শোধ হইলে আমি গ্রামে চইলা যাব। ওইখানে আমার বাবা-মা ও ছেলের কবর। ওইখানে গেলে তাদেরকেও দেখতে পারব। আর কিছু-না-কিছু একটা করে খাইতে পারব।'

'ঢাকা শহর আর ভালা লাগে না। ঢাকায় আসার পর আমার কাছ থেইকা এই শহর অনেক কিছুই কাইড়া নিছে। কিন্তু পাইছি কী?'

তবে জীবনের এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিজে সৎ পথে রয়েছেন বলে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতাও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

UK govt unveils 'tighter' immigration plans

People will have to live in the UK for 10 years before qualifying for settlement and citizenship

1h ago