এখনো স্থানীয় ‘প্রভাবশালীদের’ শোষণের বেড়াজালে সুন্দরবনের জেলেরা

সুন্দরবনের গভীরে, একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবার এজেন্টদের উপস্থিতি দেখে সবাই কম বেশি বিস্মিত হবেন। তবে বনের ভেতর তাদের এই সেবা হাজারো জেলেদের অনেক উপকারে আসে, যেসব জেলেদের অনেকেই মাছ ধরার মৌসুমে সেখানে থাকার জন্য অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করেন।
dry_fish_16nov21.jpg

সুন্দরবনের গভীরে, একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবার এজেন্টদের উপস্থিতি দেখে সবাই কম বেশি বিস্মিত হবেন। তবে বনের ভেতর তাদের এই সেবা হাজারো জেলেদের অনেক উপকারে আসে, যেসব জেলেদের অনেকেই মাছ ধরার মৌসুমে সেখানে থাকার জন্য অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করেন।

প্রতি বছর নভেম্বরে, ঠিক শীত মৌসুমের শুরুর দিকে, সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত দুর্গম এলাকা দুবলার চর দ্বীপ প্রায় ৩০ হাজার জেলে ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। জেলেরা গভীর সমুদ্রের মাছ শিকার করেন। নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে তারা বঙ্গোপসাগরমুখী এই দ্বীপে ৫টি মাস বসবাস করেন।

২০১৮ সালে ৩২টি ডাকাত দল আত্মসমর্পণ করার পর থেকে গত ৩ বছরে এই জেলেদের সংখ্যা শুধু বেড়েই চলেছে। ওই বছরের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে 'ডাকাত মুক্ত' অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়। তখন থেকেই জেলে এবং শুটকি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।

তবে নতুন একটি প্রতিবন্ধকতা এই ব্যবসার প্রবৃদ্ধিকে থমকে দিচ্ছে।

ডাকাত চলে গেলেও তাদের জায়গা নিয়েছেন একদল প্রভাবশালী ব্যক্তি; যারা 'সাহেব' নামে সুপরিচিত। বর্তমানে দ্বীপের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে কেউই এই তথাকথিত সাহেবদের অনুমতি ছাড়া একটি মাছ কিংবা মাছ ধরার নৌকাও বিক্রি করতে পারেন না।

এই সংবাদদাতা এ মাসের শুরুর দিকে দুবলার চরে সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা দাবি করেন, দ্বীপে ১৫ জন সাহেব রয়েছেন। যারা সাধারণত বন বিভাগের কাছ থেকে মাছ ধরা মৌসুমে বনের ভেতর মাছ শিকারের অনুমতিপত্র নেন।

অনুমতিপত্র নেওয়ার পর সেগুলো জেলেদের হাতে তুলে দেওয়া হয় কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত থাকে। শুধুমাত্র সেসব জেলেকেই এই অনুমতিপত্র দেওয়া হয়, যারা সাহেবদের কাছ থেকে ঋণ নিতে এবং তাদের কাছে মাছ বিক্রি করতে রাজি হন।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, তারা বনের শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য এই অনুমতিপত্র দেন। তিনি বলেন, 'প্রতি বছর কামাল (সাহেবদের নেতা কামাল উদ্দিন ওরফে কামাল মামা) এবং তার দল আমাদের কাছ থেকে ৯৮৫টি অনুমতিপত্র পান।'

বন বিভাগের সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিটি অনুমতিপত্রের জন্য ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।

তবে এই পত্রিকার সঙ্গে কথা বলার সময় কামাল উদ্দিন সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি এ ধরনের কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন।

তিনি বলেন, 'ডাকাত না থাকায় জেলেরা এখন স্বাধীনভাবে বনের ভেতর ঘুরে বেড়াতে পারেন। এটি আমার অবদানের কারণেই সম্ভব হয়েছে।'

এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এই দ্বীপের মৎস্য খাতে ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব বেড়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব পেয়েছে। ২০১৯-২০ এ রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ এবং ২০১৮-১৯ সালে ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

এর আগের বছরগুলোর তুলনায় এই রাজস্বের পরিমাণ অনেক বেশি। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্বের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৭০ লাখ এবং ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

বন কর্মকর্তা বেলায়েত জানান, ডাকাত দলের আত্মসমর্পণের কারণেই মূলত এটি সম্ভব হয়েছে। এখন দ্বীপে শান্তি বিরাজ করছে এবং মাছ ধরার মৌসুমে আরও অনেক বেশি মানুষ এখানে আসার জন্য আকর্ষিত হচ্ছেন, জানান তিনি।

বেলায়েত আরও জানান, সরকার প্রতি কুইন্টাল চিংড়ি শুটকির জন্য ৫০০ টাকা সংগ্রহ করে এবং অন্যান্য মাছের জন্য এই হার ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত হতে পারে।

এ ছাড়া, বন বিভাগ এই ৫ মাস দ্বীপে থাকার জন্য ৫০ দশমিক ৫২ টাকা ফিস নেয়। তবে দ্বীপে অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করার জন্য অথবা খোলা জায়গায় মাছ শুকোনোর জন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই বলে কর্মকর্তারা জানান।

তবে এ ক্ষেত্রেও সাহেবদের দৌরাত্ম দেখা যায়। দ্বীপের হোটেল মালিক ইকবাল শেখ দাবি করেন, তাদের দোকান প্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার করে সাহেবদের দিতে হয়। টাকার পরিমাণ দোকানের আকারের ওপর নির্ভর করে।

ইকবাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন বিভাগকে দেওয়ার জন্য তারা এই টাকা সংগ্রহ করছেন।' তবে বন কর্মকর্তা বেলায়েত জানান, তারা এ ধরনের কোনো অর্থ বিনিময়ের ব্যাপারে অবগত নন।

বেশ কয়েক বছর ধরে দুবলার চর একটি ছোট কিন্তু প্রাণবন্ত দ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছে, বিশেষ করে মাছ ধরার মৌসুমে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হয়েও এই দ্বীপের নিউ মার্কেটে প্রথাগত কাঁচাবাজারের সব ধরনের পণ্য থেকে শুরু করে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা ও ইলেকট্রনিক্সের পণ্যও পাওয়া যায়।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সালে ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর থেকে এখানে জীবনের গুণগত মানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে। তবে সাহেবরা নতুন ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করছেন এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখনো উন্নত জীবন তাদের কাছে সোনার হরিণের মতোই।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

IMF agrees to lend $1.15 billion to Bangladesh in third tranche

The International Monetary Fund (IMF) has agreed to provide $1.15 billion to Bangladesh in the third instalment under its multi-billion-dollar loan programme.

47m ago