বাংলাদেশ

ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি কারিগরদের দিনকাল

করোনা পরিস্থিতির জন্য দীর্ঘ দুই বছরের অচলাবস্থার পর ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। এখন শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে এখানকার তাঁতীদের ঘরে ঘরে। রাতদিন চলছে বাহারি ডিজাইনের সব শাড়ি বোনা।
টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার বাজিতপুরে তাঁতে শাড়ি বুনছেন কারিগর। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার

করোনা পরিস্থিতির জন্য দীর্ঘ দুই বছরের অচলাবস্থার পর ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। এখন শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে এখানকার তাঁতীদের ঘরে ঘরে। রাতদিন চলছে বাহারি ডিজাইনের সব শাড়ি বোনা।

তবে শাড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানান, ঈদের আর বেশি বাকি নেই অথচ বিক্রি আশানুরূপ নয়। এদিকে করোনার আগে বোনা অনেক শাড়ি এখনও বিক্রি হয়নি।    

দেশের যে কোনো উৎসব পার্বণে বাঙালী নারীর প্রথম পছন্দ টাঙ্গাইল শাড়ি। স্থানীয় তাঁতীদের হস্তচালিত তাঁতে তৈরি নানা রঙের বাহারি ডিজাইনের শাড়ির সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে।

হাতে বোনা টাঙ্গাইল শাড়িতে তুলে আনা হয়েছে নানা নকশা। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার

স্থানীয় তাঁতীরা জানান, পহেলা বৈশাখ এবং ঈদকে সামনে রেখে গত তিন মাস ধরে ঈদের শাড়ি তৈরি করছেন তারা।

শাড়ির জন্য সুতা বাধার কাজ চলছে। টানা দুই বছরের করোনার ধাক্কা সামলে ঈদ সামনে রেখে আশায় বুক বেঁধেছেন টাঙ্গাইলের শাড়ি কারিগররা। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার

তাঁতীরা জানান তারা সাধারণ তাঁতের শাড়ির পাশাপাশি দামি শাড়ি তৈরি করেন যার দাম ৫০০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব শাড়ি সব মানুষের চাহিদা পূরণ করে। 

টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও তাঁতী রঘুনাথ বসাক বলেন, পরিবর্তনশীল প্রবণতা ও রুচির সাথে তাল মিলিয়ে প্রতি মৌসুমে শাড়ির ডিজাইন এবং রঙে পরিবর্তন আনতে হয়।

এ বছর ঈদের জন্য নানা ধরনের শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এসবের মধ্যে অধিকাংশই সূতি, সিল্ক, হাফ সিল্ক এবং জামদানি, তিনি যোগ করেন।

ঈদকে সামনে রেখে নানা রঙে আর নকশায় তাঁতীরা বুনেছেন শাড়ি। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার

জেলার তাঁত শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় টাঙ্গাইল শাড়ির। তবে করোনা সংক্রমণ  প্রতিরোধের জন্য সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে গত দুই বছর ঈদ, পুজা, পহেলা বৈশাখ বা বসন্ত বরণে শাড়ি ব্যবসা একরকম বন্ধই ছিল।

করোনা কেটে যাবার পর ঈদ এবং পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে মহাজনের ফরমায়েসে আবার তাঁতগুলি চালু করে তাঁতীরা। একমাস আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন বিপণী বিতানসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে পাঠানো শুরু হয়ে গেছে এখানকার হস্তচালিত তাঁতে বোনা শাড়ি।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে তাঁত পল্লীতে ঘুরে ঘুরেও শাড়ি কিনছেন। এছাড়াও আসছেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ যারা অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করেন।  

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী খ্যাত জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য এই বেচাবিক্রিতে মোটেই সন্তষ্ট নন। তিনি বলেন, 'আমরা শাড়ি দোকান ভরে ফেললে কি হবে মানুষের হাতে তো টাকা নেই। শাড়ি কিনবে কীভাবে?'

পাথরাইলের আরেক শাড়ি ব্যবসায়ী স্বপন বসাক জানান, করোনার আগের বানানো শাড়িগুলো ছাড়াও এবার পহেলা বৈশাখ এবং ঈদ উপলক্ষে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ডিজাইনের প্রচুর শাড়ি। তবে রোজার শুরুতে তেমন বেচাকেনা না হলেও ঈদ এগিয়ে আসার সাথে সাথে ক্রেতা সমাগম বাড়ছে।

শহরের থানা পাড়ার বাসিন্দা শাহানা আক্তার তার ননদ-ভাবীদের নিয়ে পাথরাইল এসেছেন ঈদ উপলক্ষে শাড়ি কিনতে।

'আসলে আমরা করোনার কারণে গত দুবছর কোনো উৎসবই তেমনভাবে করতে পারিনি। অনেক দিন পর আবার অনন্দ করার সুযোগ পেয়েছি। শাড়ি কিনবো নিজের জন্য, মেয়ের জন্য, শাশুড়ির জন্য,' বলেন তিনি।

'টাঙ্গাইল শহরেও অনেক শাড়ির দোকান আছে। তবে আমরা তাঁত পল্লীতে এসেছি তাঁতীদের বাড়ির অনেক অনেক শাড়ি থেকে বেছে বেছে পছন্দসইটা কিনব বলে। দামও তুলনামুলকভাবে কিছুটা কমে পাওয়া যাবে।' 

টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার করাটিয়ায় সাপ্তাহিত শাড়ির বাজার। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার
   

দ্য ডেইলি স্টারের সাথে আলাপকালে স্থানীয় তাঁতীরা জানালেন, সুতাসহ শাড়ি তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি, শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়া এবং দাম না বাড়া এবং দক্ষ তাঁত শ্রমিকের অভাবে গত কয়েক বছর ধরেই সংকট চলছিল শত বছরের এই হস্তশিল্পে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ছোট তাঁত কারখানাগুলি। 

এদিকে করোনার কারণে তাঁত কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক দক্ষ তাঁত শ্রমিক এই পেশা ছেড়ে দিয়ে রিকশা, অটো চালনা, কৃষি কাজ বা দিনমজুরি করতে চলে গেছে। অনেকে আবার চলে গেছে বিদেশে।  জেলার তাঁত ও শাড়ি শিল্পে এখন তাই দক্ষ তাঁত শ্রমিকের তীব্র সংকট চলছে। 

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল অফিস সূত্রে জানা যায়, মাত্র কয়েক দশক আগেও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই লাখ হস্তচালিত তাঁতে প্রায় তিন লাখ তাঁত শ্রমিক কর্মরত ছিলেন  

বর্তমানে জেলায় ২৫ হাজার হস্তচালিত তাঁত এবং প্রায় তিন হাজার মেশিন চালিত (পাওয়ার লুম) তাঁত রয়েছে। তবে বর্তমানে টাঙ্গাইলে কর্মরত লাখ খানেক তাঁত শ্রমিকের অর্ধেকই প্রতিবেশী সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। 

টাঙ্গাইলের্ উৎপাদিত তাঁত শাড়ির বিক্রির জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সাপ্তাহিক হাট বসে। এর মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার শতবর্ষী করটিয়া হাট এবং জেলা শহর সংলগ্ন বাজিতপুর হাট। সারা বছর সারা দেশ থেকে পাইকাররা এসব হাটে এসে চাহিদা মতো শাড়ি কিনে নিয়ে যান। দেশের বাইরে ভারত থেকেও ক্রেতা আসেন এসব হাটে।

গত সপ্তাহে করোটিয়া হাটে গিয়ে দেখা যায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকার এবং অন্যান্যরা এসেছেন শাড়ি কিনতে। হাটের ব্যবসায়ীরা অবশ্য জানালেন ঈদের আগে এসময় পাইকার এবং ক্রেতাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা।

হাটের শাড়ি ব্যবসায়ী চন্দন বসাক জানালেন বেচাকেনা একদম নেই একথা বলবো না তবে আশানুরূপ নয়।

টাঙ্গাইলের করটিয়া হাটের ব্যবসায়ীরা বলছেন এখনও আশানুরূপ শাড়ি বিক্রি হয়নি, তবে ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

'করোনাকালে গত দুবছরে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। জানি না আর পুষিয়ে উঠতে পারবো কি না,' চন্দন যোগ করেন। 

রাজশাহী থেকে করটিয়া হাটে শাড়ি কিনতে এসেছেন শাড়ি ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম। তিনি জানালেন ঈদে বরাবরই নারীদের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে থাকে শাড়ি। আর সবারই প্রিয় টাঙ্গাইল শাড়ি।

'গত মাসে কেনা শাড়িগুলি বিক্রি হয়ে গেছে। তাই এ সপ্তাহে আবার এসেছি। এবারের গুলো বেচতে পারলে আগামী সপ্তাহে আবার আসবো,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল লিঁয়াজো অফিসের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, ঈদ উপলক্ষে এবার টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লী আবার জমজমাট হয়ে উঠেছে। গত বছরগুলোর তুলনায় এবার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির বেচা বিক্রি ভাল। তবে করোনাকালে স্থানীয় ক্ষুদ্র তাঁতী পরিবারগুলির অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষ তাঁত শ্রমিকরা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, এতকিছুর পরও টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন আর বাজার দুটোই এখনও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বাড়লে পেশা ছেড়ে চলে যাওয়া দক্ষ তাঁত শ্রমিকরা আবার তাদের পেশায় ফিরবে।

কীভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র তাঁতীদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন এবং জীবনমান উন্নয়ন করা যায় সেসব বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে ভিন্ন কর্মতৎপরতা এবং চিন্তা ভাবনা চলছে, যোগ করেন তিনি।

      

Comments

The Daily Star  | English
Sakib Jamal. Photo: Crain's New York Business. Image: Tech & Startup

Bangladeshi Sakib Jamal on Forbes 30 under 30 list

Bangladeshi born Sakib Jamal has been named in Forbes' prestigious 30 Under 30 list for 2024. This annual list by Forbes is a compilation of the most influential and promising individuals under the age of 30, drawn from various sectors such as business, technology, arts, and more. This recognition follows his earlier inclusion in Crain's New York Business 20 under 20 list earlier this year.

4h ago