কতটা নারীবান্ধব আমাদের কর্মক্ষেত্র

রাজধানীতে নারীদের বাসে উঠতে নানান হয়রানির মুখে পড়তে হয়। ফার্মগেট থেকে ছবিটি তুলেছেন প্রবীর দাশ। ছবি: স্টার

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সাদিয়া জাহান (ছদ্মনাম)। তার মেয়ের বয়স ১ বছর। কাজে আসার সময় মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে আসেন তিনি। আসলে বাধ্য হন রেখে আসতে। কারণ তার অফিসে কোনো ডে কেয়ার সেন্টার নেই।

অফিস থেকে সাদিয়ার বাসা প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। রাজধানীর প্রতিদিনের যানজট ঠেলে অফিসে যেতে সময় লেগে যায় অন্তত দেড় ঘণ্টা। ফিরতেও লাগে একই সময়। এর সঙ্গে যোগ হয় বাসে ওঠার জন্য বাড়তি সময়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১২ ঘণ্টা সন্তান থেকে দূরে থাকতে হয় তাকে। অফিসের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেও তার মন পড়ে থাকে সন্তানের কাছে।

যূথী পাল (ছদ্মনাম) কাজ করেন একটি সরকারি ব্যাংকে। তার অফিসে নারীদের জন্য আলাদা ওয়াশ রুম নেই। অস্বস্তি হলেও বাধ্য হয়ে তাকে কমন ওয়াশ রুম ব্যবহার করতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন পিরিয়ডের দিনগুলোতে।

খুশি কবির, শারমিন শামস, বীথি সপ্তর্ষি, সুমাইয়া শিফাত ও বেগম চেমন আরা তৈয়ব। ছবি: সংগৃহীত

রিফাত আক্তারের (ছদ্মনাম) কর্মজীবন শুরু হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে। বর্তমানে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। রিফাতকে তার আগের অফিসে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার চেয়েও বেশি সময় থাকতো হতো। বর্তমানে তিনি যে সরকারি অফিসে কাজ করেন সেখানেও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর আলাদা কোনো জায়গা নেই, নেই কোনো ডে কেয়ার সেন্টার।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। তবে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত পেশাজীবী নারীরা বলছেন, তাদের কর্মক্ষেত্রগুলো সে অনুসারে নারীবান্ধব করে তোলা হয়নি।

শিক্ষা অধিদপ্তরের করা 'অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্র্যাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের তখন নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশের কিছুটা বেশি। সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই হার ৩৮ শতাংশ।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে ১৯৭৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৪ শতাংশ। ১৯৮০ সালের দিকে এই হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়। আর ২০১৬-১৭ সালে এই হার দেখানো হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

এদিকে বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশের শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮৭ লাখ।

এ অবস্থায় বিজয়ের ৫০ বছরে এসে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো জানতে দ্য ডেইলি স্টার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা অন্তত ২০ জন পেশাজীবী নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যে যে সমস্যাগুলোর কথা উঠে এসেছে, তা প্রায় অভিন্ন। এ ছাড়া এমনটাও দেখা গেছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি তাদের পুরুষ সহকর্মীর আচরণ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গিরও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুমাইয়া শিফাত যেমন বললেন, 'আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রগুলো নারীবান্ধব নয়। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের সে সহযোগিতা প্রয়োজন তা খুবই সীমিত। এমনকী অনেক জায়গায় তারা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। কেউ নারীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দাবি তুললে তাকে একটু নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। বাধ্য হয়ে অনেক নারীকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।'

তিনি বলেন, 'অনেকেই মুখে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। বেতন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অনেক জায়গায় নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়।'

এই শিক্ষকের অভিমত, নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের জন্য সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অবশ্যই সংবেদশীলভাবে দেখতে হবে।

ব্যাংক কর্মকর্তা যূথী পালের কাছ থেকে জানা গেল, তার প্রতিষ্ঠানে যারা প্রধান শাখায় কাজ করেন শুধু তাদের গাড়ির সুবিধা দেওয়া হয়। অন্য শাখায় কর্মরত নারীরা এ সুবিধা পান না। এতে অনেক সময় তারা নানা হয়রানির শিকার হন। তা ছাড়া, নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়তে হয়।

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা রিফাত আক্তারের বক্তব্য, কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার ও বুকের দুধ খাওয়ানোর জায়গা থাকাটা খুবই জরুরি। এ ছাড়া অনেক সময় বিভিন্ন সেবা নিতে আসা নারীরা শিশুদের নিয়ে আসলে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য আলাদা জায়গা খোঁজেন। এ জন্য আলাদা জায়গা না থাকাটা আসলেই বিব্রতকর।

নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর বীথি সপ্তর্ষির কথায়। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'অনেক অফিস মাতৃত্বকালীন ছুটির আগে অঙ্গীকারনামায় সই করিয়ে নেয়। শর্ত থাকে যে পরবর্তী কয়েক বছর তিনি চাকরি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবেন না। এই ছুটিটা যে একজন নারীর অধিকার তা অনেকেই মানতে চান না। উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন না। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে কর্মীদের মানসিকতার বিকাশ ও প্রশান্তি না দিতে পারলে সেই উন্নয়নের আসলে কোনো সার্থকতা নেই।'

ফ্যামিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক শারমিন শামস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর মেয়েদের পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। অনেক সময় বেতন বাড়ানো হয় না। পিরিয়ডের সময় কোনো নারী অফিসে না গেলে তাকে নানা জবাবদিহি করতে হয় এবং নেতিবাচক কথা শুনতে হয়।'

তার মতে, 'আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলো নারীবান্ধব না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আমাদের মধ্যে "জেন্ডার এডুকেশন" এর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই শিক্ষা বাড়াতে হবে এবং এর পাশাপাশি সরকার ও মালিকপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।'

নিজেরা করির সমন্বয়ক ও অধিকারকর্মী খুশি কবিরের পর্যবেক্ষণ হলো, 'যারা বড় বড় পদে থাকেন তারা অনেকই নারীদের সমস্যাগুলো সমস্যাই মনে করেন না। এমনকী বড় কর্মকর্তা নারী হলেও অনেক সময় তিনি নারীর সমস্যাগুলো এড়িয়ে যান।'

তার অভিমত, অনেক জায়গায় নারীদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নেই। যৌন হয়রানির বিষয়গুলো তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখাই হয় না। অনেক সময় সম্পর্কের ভিত্তিতে তা সমাধান করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি জন্য সবার আগে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরির মানসিকতা থাকতে হবে।'

এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য বেগম চেমন আরা তৈয়বের ভাষ্য, 'আমাদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে এবং নিয়ম-কানুন মানে তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের আর কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The Inspector General of Police (IGP) has issued a comprehensive new dress code titled Police Dress Rules, 2025, detailing rank-wise uniforms and accessories for all Bangladesh Police members.

3h ago