চোখের জলে কথা কয়

টাঙ্গাইল শহরের একটি ব্যস্ত শপিংমলের সমস্ত আলো যখন মধ্যরাতে নিভে যায়, তখন পঞ্চাশোর্ধ এক নারীকে শপিংমলের এক পাশে একা বসে কাঁদতে দেখা যায়, যিনি তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর গত তিন দশক ধরে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় জীবন পার করে আসছেন বলে জানা গেছে।
টাঙ্গাইল শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি শপিংমলের সামনে বসে থাকা ওই নারীর কাছে জানতে চাই কে তিনি, কেন কাঁদছেন- কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে কেবল মাটির দিকে চেয়ে থাকেন।
স্থানীয়রাও তার পরিচয় জানেন না। স্থানীয় বাসিন্দা দুর্জয় হোড় জানান, 'গত কয়েকবছর ধরে দেখছি শপিং মলের সামনে কাঁথা-কম্বল আর পানির একটা বোতল নিয়ে বসে থাকেন। আবার সকালে কোথায় যেন চলে যান।'
মার্কেটের নৈশ প্রহরীরা জানান, রাতে রিক্সায় এনে ওই নারীকে শপিং মলের সামনে রেখে যাওয়া হয়, সকালে শপিং মল খোলার আগেই চলে যান। গত কয়েকবছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। মানবিক কারণে তারা কিছু বলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিনের বেলায় কাছাকাছি বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মোড়ে একটি মুদির দোকনের সামনের ফুটপাতে বসে থাকেন ওই নারী। রাতে দোকান মালিক কৃষ্ণ সাহা তাকে রিক্সায় তুলে দেন ওই মার্কেটের সামনে রেখে আসার জন্য।
কৃষ্ণ জানান, 'ওর নাম রায় কিশোরী। বছর পাঁচেক আগে আমি ওকে রাস্তার ধারে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমার দোকানের কাছে নিয়ে এসেছিলাম। খাইয়ে দাইয়ে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর থেকে সে এখানেই থেকে গেছে। রাতে দোকান বন্ধ করে চলে যাবার আগে তাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে যাই ওই মার্কেটের সামনে ঘুমানোর জন্য।'
কৃষ্ণর স্ত্রী আরতী সাহা জানান, রায় কিশোরী সারাদিন রাস্তার পাশেই বসে থাকে। মানুষ দয়া করে পাঁচ/দশ টাকা বা খাবার দাবার দিয়ে যায়। তবে সে নিজে কারো কাছে কিছু চায় না। মানুষের দেয়া খাবারগুলিও সে অধিংকাশ সময় খেতে চায় না। মানুষের দেয়া টাকাগুলো টোকাই এবং মাদকাসক্তরা কেড়ে নিয়ে যায়। কথা সে বলে না বললেই চলে। তার অভিব্যক্তি প্রকাশের একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে কান্না। তবে আমার স্বামী কোনো কিছু জানতে চাইলে কদাচিত দু'একটা কথার উত্তর দেয়। দোকানের ভার কিছুক্ষনের জন্য আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমার স্বামী তাকে মাঝে মাঝে খাইয়ে দেয়া, চুল-নখ কাটানো বা মশার কয়েল জ্বালিয়ে দেয়ার মতো কাজগুলি করে দেয়।'
আরতী আরও জানায়, রায় কিশোরীকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে কয়েকবার কিন্তু সে কোনোভাবেই যেতে রাজি হয়নি। জোর করলেই কেঁদেছে। একবার টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি তাকে তার বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যেতে অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু নিতে পারেনি।
রায় কিশোরী সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন শহরের তরুণ মানবাধিকার কর্মী নওশাদ রানা সানভী। সানভী জানান, রায় কিশোরীর জন্ম টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বৈল্যা গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে। তার পিতা গেন্দু পাল পেশায় ছিলেন একজন কুমোর। গ্রামের অন্য পরিবারগুলির মতো মাটির হাড়ি-পাতিল এবং অন্যান্য সামগ্রী তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করতো পরিবারটি।
গেন্দু পালের তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে রায় কিশোরী ছিল সবার ছোট। বাবা-মায়ের মৃত্যু তার জীবন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে সানভী জানতে পেরেছেন, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর রায় কিশোরীর বড় তিন ভাই গুপেশ্বর পাল, নগেন পাল ও নরেশ পাল ১৯৯০ সালে পৈতৃক জমিজমা বিক্রি করে দিয়ে পরিবার নিয়ে ভারতে চলে যায়। বোন রায় কিশোরীকেও তারা সাথে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর সে একা ফিরে আসে।
তবে তার ফিরে আসা নিয়ে দুই রকম কথা স্থানীয়দের মধ্যে। একদল জানেন স্থলপথে দেশ ত্যাগের সময় ভাইয়েরা সীমান্ত এলাকায় রায় কিশোরীকে ফেলে রেখে চলে যায়। আবার একদল জানেন আসলে ফেলে যায়নি, রায় কিশোরী নিজেই চলে এসেছিল।
জানা গেছে, ফিরে আসার পর আপনজনহীন অসহায় রায় কিশোরী মানুষের বাড়ি কাজ করেছে। রাতে আশ্রয় নিয়েছে বৈল্যা বাজারের একটি ঘরের বারান্দায়। সেখানে থাকতে থাকতেই একদিন ভাত রাঁধতে গিয়ে আগুনে পুড়ে আহত হয় সে। পরে কবে কীভাবে সেখান থেকে সে টাঙ্গাইল শহরে এসেছে তা কেউ জানাতে পারেনি।
Comments