ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির ট্রেন: শিগগির সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় চীন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের অক্টোবরে দেওয়া এক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর) ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগের সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের অক্টোবরে দেওয়া এক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর) ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগের সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশাল ব্যয়ের বিষয়টি সামনে এলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি নিয়ে 'ধীরে চলো নীতি' গ্রহণ করে। প্রকল্পটির আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৯৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

তবে সম্প্রতি চীন আগ্রহী হয়ে প্রকল্পটি গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি)  পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিলে প্রকল্পটি আবার আলোচনায় আসে।

চীন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডকে (সিআরইসি) পদ্মা সেতুর চেয়ে ৩ গুণ বেশি খরচের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত করে।

গত এপ্রিলে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে 'যত দ্রুত সম্ভব' সিআরইসি ও বিআর'র মধ্যে সমঝোতা স্মারক সইয়ের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন।

এ ছাড়াও, দ্রুতগতির রেল প্রকল্প নিয়ে জিটুজি-পিপিপি কাঠামোর আওতায় ২ দেশের সরকারের মধ্যে 'অদূর ভবিষ্যতে' সমঝোতা স্মারক সইয়ের আশা প্রকাশ করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।

জিটুজি-পিপিপি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ এ ধরনের প্রকল্পের জন্য অন্যান্য দেশের সরকারকে আর্থিক সহায়তার জন্য এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের অনুরোধ করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত জিটুজি-পিপিপি চুক্তির অধীনে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। এ ধরনের কাঠামোয় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।

চীনের প্রস্তাব এমন সময় এলো যখন দেশের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের বিশাল বাজেটের প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, এই 'উচ্চাভিলাষী' প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাংলাদেশ রেলওয়ের নেই।

এমনকি, গত বছর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, বিশাল খরচার কারণে সরকার এই প্রকল্প নিয়ে 'ধীর গতিতে' অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, 'এতো বিশাল বাজেটের প্রকল্পে বিনিয়োগ করার বদলে আমরা অন্যান্য অতি-প্রয়োজনীয় প্রকল্পে বিনিয়োগ খুঁজছি। অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পেও গুরুত্ব দিচ্ছি।'

অর্থের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপি বাংলাদেশ রেলওয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠাবে কি না সে বিষয়ে গত মার্চে রেলসচিবের নেতৃত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি এক সভায় এ বিষয়ে রেলমন্ত্রীর মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ নিয়ে মন্তব্য করতে রেলমন্ত্রী, রেলসচিব ও অতিরিক্ত রেলসচিবকে (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) না পাওয়ায় ডেইলি স্টার মূল্যায়ন কমিটির উদ্যোগের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব রেলওয়েস'র মতে, আপগ্রেটেড রেললাইনে একটি দ্রুতগতির ট্রেনের গতি কমপক্ষে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার হতে হবে। আর নতুন রেললাইনে এর গতি হতে হবে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বা তার বেশি।

গত ডিসেম্বরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির পাবলিক ট্রেনের মাধ্যমে সাংহাইয়ের পুডং বিমানবন্দর থেকে সাংহাই শহরের কেন্দ্রস্থলে লংইয়াং রোড স্টেশনে যাওয়া যায়।

প্রতিবেদন মতে, ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার থেকে ৪৬০ কিলোমিটার গতির বিশ্বসেরা ১০টি ট্রেন চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, মরক্কো, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও সৌদি আরবে আছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদের মধ্যে প্রথম দ্রুতগতির ট্রেন প্রকল্পের কাজ চলছে। এই বুলেট ট্রেনটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩২০ কিলোমিটার বেগে চলবে।

প্রস্তাবিত নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনীর ভেতর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের ২২৪ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার পথে দ্রুতগতির ট্রেনে নিরবচ্ছিন্নভাবে যেতে সময় লাগবে ৫৫ মিনিট। তবে বিভিন্ন স্টেশনে থামার সময়সহ মোট লাগবে ৭৩ মিনিট। বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ট্রেনে যেতে সময় লাগছে ৬ ঘণ্টার বেশি।

তবে এই যাতায়াত কম খরচে করা যাবে না। ধারণা করা হচ্ছে, জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২ হাজার টাকা, যা এখনকার আন্তঃনগর ট্রেনে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আসনের টিকেটের দামের চেয়ে ৩ গুণের বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়োজাহাজে সর্বনিম্ন ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা।

প্রতিদিন একেকটি ট্রিপে প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে পারবেন। বুলেট ট্রেনটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার গতিবেগে চলতে পারবে।

প্রকল্প

২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর রেল মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতির বুলেট ট্রেনের বিষয়টিও ছিল।

বহির্বিশ্বে দেশের ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে দেশের অর্থনীতির 'লাইফলাইন' হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই তুলনায় সেই পথে পণ্য পরিবহনে রেলের অবদান খুবই সামান্য।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতোমধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা করেছে। এতে খরচ হয়েছে ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

চীনা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বাধীন একটি কোম্পানি এর সমীক্ষার কাজ করে। তাদের মত, প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে।

দ্রুতগতির রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রূপপুরের পর এটিই হবে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা।

এর আগে ২টি চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন—যৌথ উদ্যোগে পিপিপি মডেলের আওতায় দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও অর্থায়নের কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে।

যৌথ উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে গত বছরের মার্চে বৈঠক করে। সেখানে এ বিষয়ে ইআরডি'র মতামত জানতে চাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর আর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, এটি একটি 'উচ্চাভিলাষী প্রকল্প'। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ প্রকল্পে কিছু ঝুঁকিও আছে।

গত ২১ মে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বলব না এমন প্রকল্প নেওয়া যাবে না। তবে তা পরিস্থিতির ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। যদি আগামী ৬ থেকে ৭ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলমান থাকে তাহলে এমন প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। যদি আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে বিশাল বাজেটের এই প্রকল্প দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।'

'এসব বিবেচনায় নিলে, এই প্রকল্প ঝুঁকিপূর্ণ,' যোগ করেন তিনি।

তার মতে, 'বিদেশি ঋণে অথবা পিপিপি'র আওতায় প্রকল্প নিলে ফলাফল একই হবে। কেননা, দিন শেষে সরকারকেই দায় নিতে হবে।'

দ্রুত সমঝোতা স্মারক সই করুন: চীনের রাষ্ট্রদূত

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত গত ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর তাদের মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠকের কথা উল্লেখ করেছেন। জিটুজি-পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে সে সময় দুই পক্ষই একমত হয়েছিল বলে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) সম্প্রতি দ্রুতগতির রেল প্রকল্পটি নিয়ে 'আগ্রহ' প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে।

সিআরইসি পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে এই ২ ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে। সিআরইসি'র একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতুর ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।

রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, রেলওয়ের নকশা ও নির্মাণ কাজে সিআরইসি'র খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ১৯৯০ এর দশক থেকে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে কাজ করছে।

দ্রুতগতির রেল প্রকল্প বাস্তবায়নে সিআরইসি'কে বাংলাদেশ রেল মন্ত্রণালয়ের 'যোগ্য অংশীদার' হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ে ও চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের মধ্যে দ্রুত সমঝোতা চুক্তি সইয়ের পরামর্শ দেন।

তিনি সম্ভাব্যতা যাচাই, অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন ও প্রকল্প পরিচালনায় সিআরইসি'কে 'প্রয়োজনীয় সহযোগিতা' দিতে রেল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছেন।

চিঠিতে আরও লিখেছেন, 'আমরা আশা করতে পারি' যে প্রকল্পটি জিটুজি-পিপিপি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসতে দুই দেশ অদূর ভবিষ্যতে সমঝোতা স্মারকে সই করবে।'

বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্র জানিয়েছে, যদি সিআরইসি'কে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারা যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি মালবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য পরিকল্পনা করবে। তখন এর গতি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটারে কমিয়ে আনা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চীনের রাষ্ট্রদূতের চিঠি পাওয়ার পর রেল মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মতামত চায় এবং রেলওয়ে তাদের মতামত দিয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

রেলওয়ের ওই কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, তারা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন যে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির (পিপিপিএ) জিটুজি-পিপিপি কাঠামো সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকায় সিআরইসির সঙ্গে এমন সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রয়োজন নেই।

গত ২৫ মে রেলসচিব হুমায়ুন কবির সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়ে গিয়েও দেখা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। তাকে ফোনেও পাওয়া যায়নি। পরদিন রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে গেলে তার দেখা মেলেনি। তাকে ফোনেও পাওয়া যায়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Govt primary schools asked to suspend daily assemblies

The government has directed to suspend daily assemblies at all its primary schools across the country until further notice due to the ongoing heatwave

8m ago