ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে: উচ্চ হারে টোল প্রস্তাব, আদায় শুরু ১ জুলাই

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্ধারিত টোল হার কার্যকরের আগেই সরকার তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এর ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে এবং বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে হবে জনসাধারণকেই।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্ধারিত টোল হার কার্যকরের আগেই সরকার তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এর ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে এবং বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে হবে জনসাধারণকেই।

গত বছরের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের প্রস্তাবনা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় পদ্মা সেতু চালু না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ভিত্তি টোল প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা করার অনুমোদন দিয়েছিল।

তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ভিত্তি টোল হিসেবে সম্প্রতি ৪টি হার প্রস্তাব করেছে। এগুলো হলো ১৮ টাকা ৪০ পয়সা, ২৫ টাকা, ৩৩ টাকা ৭১ পয়সা ও ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা, যা পূর্ব নির্ধারিত হারের চেয়ে ৮৪ থেকে ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।

একটি মাঝারি আকারের ট্রাকের (২ অ্যাক্সেল বিশিষ্ট) জন্য প্রতি কিলোমিটারের টোল ভিত্তি টোল হিসেবে বিবেচিত হয়।

এক্সপ্রেসওয়ে ও টোল প্লাজার ৪টি প্রবেশ ও বাহির পথ তৈরি না হওয়ায় অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় ওই টোল হার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

নতুন প্রস্তাব করা হার বেশি দেখে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি এক বৈঠকে ভিত্তি টোল ১৫ টাকা কিংবা ১৮ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করার পক্ষে মত দিয়েছে।

তবে, আগামী মাসে সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হতে পারে। বৈঠকের পরই এক্সপ্রেসওয়ের টোলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দেশের প্রথম নির্মিত এই এক্সপ্রেসওয়ের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সওজ অবশ্য আগামী ১ জুলাই থেকে টোল আদায় শুরু করবে। নতুন টোল হার নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য যে হার নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেই হারে তারা টোল আদায় করবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এই এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে পড়েছে পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে সেতুর জন্য টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। সেটিও পদ্মা নদী পার হতে ফেরির জন্য গড় খরচের প্রায় দেড় গুণ বেশি।

অর্থাৎ এই পথে যানবাহনগুলোর খরচের তালিকায় শিগগির এক্সপ্রেসওয়ের টোল ও সেতুর টোল দুটোই যোগ হতে যাচ্ছে।

এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের টোল

অন্তর্বর্তীকালীন নির্ধারিত টোল প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা হিসাবে একটি মাঝারি আকারের ট্রাককে পুরো ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের জন্য ৫৫০ টাকা দিতে হবে।

একটি বাসের টোল হবে ৪৯৫ টাকা (ভিত্তি টোলের ৯০ শতাংশ), একটি সেডান গাড়ির টোল ১৩৮ টাকা (২৫ শতাংশ) এবং একটি মোটরসাইকেলের টোল ২৮ টাকা (৫ শতাংশ)।

পদ্মা সেতু পার হতে মাঝারি আকারের একটি ট্রাককে ২ হাজার ১০০ টাকা, একটি বাসকে ২ হাজার ৪০০ টাকা, প্রাইভেটকার ও জিপের জন্য ৭৫০ টাকা এবং একটি মোটরসাইকেলকে ১০০ টাকা টোল দিতে হবে।

তবে এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তি টোল ১৫ টাকা হলে, একটি মাঝারি আকারের ট্রাককে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে ৮৩৩ টাকা দিতে হবে। ভিত্তি টোল ১৮ টাকা ৪০ পয়সা হলে ১ হাজার ২০ টাকা, ভিত্তি টোল ৩৩ টাকা ৭১ পয়সা হলে ১ হাজার ৮৫৪ টাকা দিতে হবে।

অন্যান্য যানবাহনের জন্য টোল হারও সেই অনুযায়ী বাড়বে।

প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ ব্যয় বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক। ১১ হাজার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত ৫৫ কিলোমিটার এই এক্সপ্রেসওয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের সালের মার্চে উদ্বোধন করেন।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক সভায় তিনি জাতীয় মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন থেকে টোল আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদায়কৃত অর্থ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয়ের কথা বলা হয়।

পরের বছর টোল নীতি ২০১৪ অনুযায়ী সওজ এক্সপ্রেসওয়ের জন্য একটি টোল কাঠামো তৈরি করে। টোল নীতিতে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েতে প্রতি কিলোমিটারে ভিত্তি টোল ২ টাকা এবং ৭৫০ মিটারের বেশি দীর্ঘ সেতুর টোল ৪০০ টাকার কথা উল্লেখ আছে।

টোল কাঠামো তৈরির পর পরিবহন সমিতিসহ সংশ্লিষ্টরা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল।

টোল সংশ্লিষ্ট কমিটির সুপারিশ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে মহাসড়ক অধিদপ্তর ভিত্তি টোল হিসেবে ১০ টাকা প্রস্তাব করলে গত বছরের ৪ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করে।

নতুন প্রস্তাব

আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হতে যাচ্ছে। এটিকে মাথায় রেখে সওজ এক্সপ্রেসওয়ের জন্য টোল নির্ধারণে ৪টি প্রস্তাব জমা দিয়েছে।

এর একটি কিলোমিটার প্রতি ১৮ টাকা ৪০ পয়সা। টোলনীতি ২০১৪ অনুযায়ী ভিত্তি টোল হিসেবে এটিই নির্ধারণ হওয়ার কথা।

তবে, টোলনীতি প্রণয়নের সময়কালের সঙ্গে চলতি বছর পর্যন্ত ৭ বছরের মুদ্রাস্ফীতি সামঞ্জস্য করে এবং দেশের অন্যান্য মহাসড়কের তুলনায় এক্সপ্রেসওয়ের মান বিবেচনা করে সওজ প্রতি কিলোমিটারে ভিত্তি টোল ৩৩ টাকা ৭১ পয়সার একটি প্রস্তাবও দিয়েছে।

মজার বিষয় হলো, আরেকটি প্রস্তাবে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই অন্তর্বর্তীকালীন ভিত্তি টোল হারকে আড়াই গুণ করে ২৫ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া, অপর একটি কমিটির এর আগে ভিত্তি টোল হার ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা করার একটি প্রস্তাবও সওজ নতুন প্রস্তাবনায় রেখে দিয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক অধিদপ্তর গত ১৯ মে একটি সভায় টোলের এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করে।

সূত্র জানায়, সভায় প্রস্তাবিত টোলের এই হারকে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। তাদের সুপারিশ, ভিত্তি টোল হার অন্তর্বর্তীকালীন হারের দেড় গুণ অর্থাৎ ১৫ টাকা কিংবা টোলনীতি অনুযায়ী ১৮ টাকা ৪০ পয়সার বেশি হওয়া উচিত নয়।

অধিদপ্তর টোলের হার নিয়ে আলোচনা করতে গত ২৪ মে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিল।

কিন্তু ওই বৈঠক স্থগিত করা হয়।

সূত্র জানায়, অধিদপ্তরের বিদায়ী সচিব নজরুল ইসলাম চেয়েছিলেন যে ৪ জুন থেকে নতুন সচিব দায়িত্ব নেওয়ার পর টোল নির্ধারণ করা হোক।

কর্তৃপক্ষ কী করবে

এক্সপ্রেসওয়েটি সওজ ঢাকা জোনের অধীনে। এই জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান গতকাল সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আগামী ১ জুলাই এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় শুরু হবে।

তিনি বলেন, 'একটি নতুন টোল হার নির্ধারণ করা হবে। যদি ১ জুলাইয়ের আগে নতুন টোল হার নির্ধারণ করা না যায়, তাহলে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন টোল হার অনুসরণ করে টোল আদায় শুরু করব।'

গত বছরের আগস্টে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনকে (কেইসি) এই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে।

তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সবুজ উদ্দিন বলেন, 'আমরা আগামী ৭-১০ দিনের মধ্যে (কেইসির সঙ্গে) চুক্তি সই করার আশা করছি। তবে তারা এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ শুরু করেছে।'

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টোল আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় মূল অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে।

কেইসি টোল আদায়ের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটি ইনস্টল করতে তাদের আরও ৩ মাস লাগবে। ততদিন পর্যন্ত আমরা ম্যানুয়ালি টোল আদায় করব।'

তবে টোল হার বেড়ে গেলে তার ব্যয়ভার জনগণের ওপরই পড়বে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী সভাপতি এবং বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড-ভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনেরও সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টোল বাড়লে শেষ পর্যন্ত পরিবহন ভাড়া বাড়বে এবং জনগণকেই তা বহন করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'আমরা প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর টোল হার কমানোর অনুরোধ জানাতে একটি সংবাদ সম্মেলনের পরিকল্পনা করছিলাম। এমন সময়ে এক্সপ্রেসওয়ের টোল হার বাড়ছে শুনে আমাদের উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল।'

যোগাযোগ করা হলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের বিদায়ী সচিব নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন টোল হার ঠিক করা হয়েছিল পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত। তাই সেতু চালু হলে টোলের হার বাড়ানো হবে।'

তিনি বলেন, 'বর্তমানে এই রুটে ৩টি সেতুতে টোল দিতে হয়। ৩টি সেতুর টোলের হিসাব করলে পুরো এক্সপ্রেসওয়ের টোল খুব একটা বেশি নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রস্তাবিত টোল হার বাস্তবায়নাধীন ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে এবং রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্ধারিত হারের চেয়ে কম।'

'উন্নয়নের সুফল পাবে মানুষ। সুতরাং, অন্যান্য দেশের মতো তাদেরও এটি ব্যবহারে অর্থ ব্যয় করতে হবে। কর্তৃপক্ষ এটিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে,' যোগ করেন তিনি।

পরিবহন ব্যয়ের ওপর টোলের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, 'পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর কথা ভাবছেন। কিন্তু তাদের বিবেচনা করতে হবে যে এক্সপ্রেসওয়ের কারণে তাদের ট্রিপ বাড়াবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচ কমাবে।'

Comments