মা মৃণালিনী কীভাবে বেঁচে থাকবেন

মা মৃণালিনীর ৫ ছেলে মুহূর্তের মধ্যে মারা গেল, ১ ছেলে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পড়ে রইল। সুস্থ থাকা একমাত্র সন্তান প্লাবন সুশীলও চোখের সামনে ৫ ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
৮ ভাইয়ের ৬ জনই মারা গেছেন। একজন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে। আর অপরজন চোখের সামনে ৫ ভাইয়ের মৃত্যু দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

মা মৃণালিনীর ৫ ছেলে মুহূর্তের মধ্যে মারা গেল, ১ ছেলে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পড়ে রইল। সুস্থ থাকা একমাত্র সন্তান প্লাবন সুশীলও চোখের সামনে ৫ ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

মৃণালিনী শুধু বুক চাপড়াচ্ছেন আর বারবার বলছে, 'ঠাকুর আমার সন্তানরা তো কোনো দিন কারো ক্ষতি করেনি। কেন তুমি তাদেরকে এভাবে নিয়ে গেলে। আমাকেও তুমি নিয়ে যাও, আমাকেও তুমি নিয়ে যাও।'

চোখের সামনে ৫ ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে প্লাবন সুশীল। স্বামী-সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় মৃণালিনী। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা প্লাবনকে বোঝানো হচ্ছে, তার ভাইয়েরা ঢাকায় চাকরি করতে গেছে। খুব শিগগির তারা বাড়ি ফিরে আসবে।

ভাইদের রক্তাক্ত শরীর নিয়ে সেদিন প্রায় ১ ঘণ্টা গগণ বিদারী চিৎকার করেছিল প্লাবন। এরপর থেকেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বলে জানান সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ছোটন সুশীল।

গত রোববার ঘোষণা করা হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার ফল। এবার পাসের তালিকায় থাকা ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭১৮ জনের মধ্যে একজন প্লাবন।

১ মাস বয়সী সন্তান কোলে স্মরণ সুশীলের স্ত্রী তৃষ্ণা রানী সুশীল। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

মেয়ের নাম রেখে যেতে পারলেন না বাবা

তৃষ্ণা রানী সুশীল বলছিলেন, 'বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে মেয়ের নামকরণ করব, এটা বলার ২ দিন পর আমার স্বামী এভাবে চলে গেলেন। গতকাল আমার মেয়ের বয়স ১ মাস পূর্ণ হলো।'

কাঁদতে কাঁদতে তৃষ্ণা বলেন, 'আমার স্বামী স্মরণ সুশীলের সেলুনের দোকান ছিল। ৫ বছরের ১ ছেলে আর ১ মাসের মেয়ে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমরা কীভাবে বাঁচব।'

দেবশ্রীর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অনিশ্চিত

এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন অনুপম সুশীল। তিনি ছিলেন গ্রাম্য ডাক্তার।

অনুপমের স্ত্রী পপি সুশীল বলেন, 'খেয়ে না খেয়ে মেয়ের জন্য প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা টিউশন ফি দিতেন তার বাবা। চেয়েছিলেন মেয়ে দেবশ্রী একদিন বড় ডাক্তার হবে।'

'আমাদের আরেক সন্তান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। কীভাবে ওদের পড়ালেখা চালিয়ে নিব,' বলেন পপি।

বিজ্ঞান বিভাগের ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী দেবশ্রী বারবার বলছে, 'তোমরা শুধু আমার বাবাকে এনে দাও।'

নিজ বাড়ির উঠানে একটি মন্দির তৈরি করতে ইট-কঙ্কর কিনেছিলেন দীপক সুশীল। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

মন্দির করা হলো না দীপকের

কাতার ফেরত দীপক সুশীল এ ছেলের জনক। তার স্ত্রী মুন্নি শর্মা পূজা বলেন, 'দীপক চেয়েছিলেন হাসিনা পাড়া এলাকার নিজ বাড়ির উঠানে একটি মন্দির তৈরি করবেন। মন্দিরের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইট-কঙ্করও নিয়ে এসেছিলেন। গত ২৯ জানুয়ারি আমাদের বাড়িতে অজ্ঞাত কিছু লোক হামলা করে। তারা আমাদের বাড়ি-ভাঙচুর করেছিল।'

পুরুষশুন্য বাড়িটিতে এই মানুষগুলো কতটা অনিরাপদ বোধ করছেন সেই কথা বারবার বলছিলেন পূজা।

অসুস্থতা থেকে চিরমুক্তি চম্পকের

এর আগেও দূর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন চম্পক সুশীল। দূর্ঘটনার পর শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন না তিনি। ফলে কোনো কাজ করতে পারতেন না।

চম্পকের স্ত্রী দেবিকা সুশীল বলেন, 'আমাদের ৪ বছর এবং দেড় বছরের ২ মেয়ে। আমাদের সংসার চালিয়ে নিত ওনার ভাইয়েরা।'

স্ত্রীকে একেবারেই একা করে গেলেনে নিঃসন্তান নিরুপম

বেসরকারি একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন নিরুপম সুশীল। সুশীল ও তার স্ত্রী গীতার নেই কোনো সন্তান।

তার স্ত্রী গীতা সুশীল বলেন, 'আমাদের কোনো সন্তান না থাকলেও আমরা অনেক সুখী ছিলাম। এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচব।'

শুক্রবার বিকেলে নিহত ৫ ভাইয়ের স্মরণে বাড়িতে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হয়। ছবি: সংগৃহীত

এখনও হাসপাতালে ২ ভাই-বোন

দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এই পরিবারের ২ জনকে। ভাই রক্তিম সুশীল এবং বোন হীরা সুশীল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

তাদের বোন মুন্নি সুশীলের স্বামী খগেশপ্রতি চন্দ্র খোকন জানান, রক্তিমকে গত রোববার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

হীরা সুশীল চট্টগ্রামের চকরিয়ায় মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

কী হয়েছিল সেদিন

৮ ফেব্রুয়ারি সকাল প্রায় পৌনে ৬টা। বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে ঢাকা-কক্সবাজার সড়কের প্রায় ২০ ফুট দূরে নির্জন একটি জায়গায় বাবার জন্য দণ্ডি (পরিবারের কোনো সদস্য মারা যাওয়ার পর হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী একটি রীতি) দিয়ে ৯ ভাই-বোন একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন।

সেখানে একটি দ্রুতগামী পিকআপ তাদের ৭ ভাই-বোনকে চাপা দেয়। এ ঘটনায় মারা যান অনুপম সুশীল, নিরুপম সুশীল, দীপক সুশীল ও চম্পক সুশীল। সেদিনই বিকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্মরণ সুশীল।

গত ২৯ জানুয়ারি হামলা করা হয় মৃণালিনীদের বাড়িতে। এর পরের দিন তার স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

বোন মুন্নির বর্ণনায় দুর্ঘটনার সময়

ঘটনাস্থলে ভাই-বোনদের সঙ্গেই ছিলেন মুন্নি সুশীল। সেদিনের কথা জানতে চাইলে মুন্নি বলেন, 'সেদিন আমি এবং আমার আরেক ভাই প্লাবন ছিলাম রাস্তার উপরে। বাকিরা ছিল রাস্তা থেকে প্রায় ২ হাত দূরে। কিন্তু রাস্তায় থাকায় পরও আমাদেরকে না মেরে আমার ভাইদেরকে অনেকটা টার্গেট করে পিষে দিয়েছিল ঘাতক পিকআপ ভ্যানটি। প্রথমে একবার চাপা দিয়ে আবার পিকআপটি পেছনে এনে আমার আহত বোনকে আবার পিষে দেয়।'

তিনি আরও বলেন, 'এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তা না হলে রাস্তার ওপরে দাড়িয়ে থাকা আমাদের ২ জনকে না মেরে কেন রাস্তা থেকে ২ হাত দূরে গিয়ে আমার ভাইদের এভাবে পিষে মারল।'

কেন এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে হচ্ছে জানতে চাইলে মুন্নি বলেন, 'গত ২৯ জানুয়ারি ৪০ থেকে ৫০ জন দুষ্কৃতিকারী আমাদের বাড়িতে হামলা করেছিল। আমার বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। এর ঘটনার পরের দিন ৩০ জানুয়ারি আমার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।'

কারা এবং কেন হামলা করেছিল জানতে চাইলে মুন্নি বলেন, 'গত ১০ বছর ধরে আমার বাবা এখানে পারিবারিকভাবে দুর্গা পূজা করে আসছিলেন। জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার ভাই দীপক সুশীল হাসিনাপাড়া এলাকায় একটি ছোট মন্দির করার জন্য প্রায় ৪ হাজার ইট এবং দেড়শ ফুট কঙ্কর এনেছিলেন। এরপর থেকেই আমার বাবা বিভিন্নভাবে হুমকি পাচ্ছিলেন।'

প্রতিবেশীদের ভাষ্য

কামাল হোসেন নামে স্থানীয় একজন বলেন, 'কিছুদিন আগে পার্শ্ববর্তী এলাকার মো. এমরান নামে একজনের সঙ্গে প্লাবন সুশীলের ঝগড়া হয়েছিল। এরপর উত্তেজিত কিছু লোক তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তবে, এই ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।'

সুনন্দ দাশ নামে একজন প্রতিবেশী বলেন, 'সেদিন হামলার সময় আমরা কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হইনি।'

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

12h ago