৭ মাসে সড়কে মৃত্যু বেড়েছে ৪০ শতাংশ

মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে, এ বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
পুলিশের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছরের প্রথম সাত মাসে ৩ হাজার ২৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি।
বিশেষজ্ঞ ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কর্মীরা জানান, লকডাউনের সময় বাস ও মিনিবাস বন্ধ থাকায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও অবৈধ তিন চাকার যানবাহনসহ বহু ছোট যানবাহন চলাচল করে। এর ফলে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।
দুর্ঘটনা রোধে, বিশেষ করে ঈদ যাত্রা নিরাপদ রাখতে সরকারের নজরদারিরও মারাত্মক ঘাটতি ছিল। এ ছাড়া, দুর্ঘটনা রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ করোনা মহামারির কারণে ভেস্তে যায়।
২০১৮ সালের জুলাই থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দুটি বড় আন্দোলন হয়েছে। এরপর কর্তৃপক্ষ সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। কিন্তু, সেই উদ্যোগগুলো যে কাজে লাগেনি, সাম্প্রতিক উপাত্ত তার প্রমাণ।
মৃত্যু বেড়েছে ৪০ ভাগ
গত বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ২৯১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছর একই সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩ হাজার ২৫৯টি। অর্থাৎ দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
পুলিশের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সংখ্যা ছিল ৫৪৩।
এ ছাড়া, গত বছরের প্রথম ৭ মাসে ২ হাজার ২১১ জন মানুষ সড়কে নিহত হলেও, চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৫ জনে। অর্থাৎ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
পুলিশ প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর যে সংখ্যা দেওয়া আছে, নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে তা আরও বেশি।
দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ
কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে দেশে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। দুই মাসের বেশি সময় এ বিধিনিষেধ চলে। এ সময় গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহন দিয়ে মহাসড়ক ভরে যায়।
এর পাশাপাশি ব্যস্ত মহাসড়কে মালবাহী যানবাহনের চলাচল অব্যাহত থাকায় সংঘর্ষ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। গত ৫ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টারের কথা বরার সময় এ কথা বলেন তিনি।
গত ২৩ মে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ঈদের সময় দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও, ১৫ দিনে ৩১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৩২৩ জন নিহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৪ বছরে এবারই ঈদের সময় সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ঈদের আগে এ ধরনের ভিড় দেশে খুব সাধারণ ঘটনা হলেও, এবার গণপরিবহনের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। কারণ, বেশি মানুষ মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাড়ি গেছেন।
এ ছাড়া, দুর্ঘটনা রোধে কোনো ব্যবস্থা ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ট্রাফিক আইন, বিশেষ করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন না করা দুর্ঘটনা বাড়ার বড় কারণ।
'নিরাপদ সড়ক চাই'-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, ২০১৬ সাল থেকে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, দেশে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত বাইকের সংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৭৮ লাখ। চলতি বছরের মে মাসে তা বেড়ে ৩২ দশমিক ৫৮ লাখ হয়ে যায়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে 'নিরাপদ সড়ক চাই' জানায়, ২০১৯ সালে বাইক দুর্ঘটনার ১৯ শতাংশ ছিল। গত বছর তা বেড়ে ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, মহাসড়কে নসিমন ও করিমনের মতো থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ হলেও, অবৈধভাবে এগুলো চলছে।
২০১৪ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্ট সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স চলতি বছরের জুন মাসে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, সেই সিদ্ধান্ত এখনও কার্যকর হয়নি।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মতে, বিধিনিষেধে বাস ও মিনিবাস বন্ধ থাকায় বেপরোয়াভাবে ছোট যানবাহন চলেছে। এ জন্যই দুর্ঘটনা বেড়েছে।
তদারকির অভাবের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের কাজ করছি এবং দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছি।'
এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মল্লিক ফকরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments