‘নিজস্ব সাহিত্য শৈলী হাসান আজিজুল হককে চিরঞ্জীব করে রাখবে’

লেখকরা প্রায়শই তাদের ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য শৈলী উদ্ভাবনের ক্ষমতা থেকে আবির্ভূত হন এবং কঠিন বাস্তবতাগুলোকে সহজে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতার জন্য তারা চিরঞ্জীব হন।

যেমন কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিজস্ব অনন্য শৈলী ছিল। বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকও তেমনই ছিলেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খানের ভাষ্যে এসব কথা উঠে এসেছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে হাসান আজিজুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন।

আকরাম খান হাসান আজিজুল হকের দুটি ছোট গল্প— দেশভাগ নিয়ে 'খাঁচা' ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প 'বিধবাদের কথা' চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন।

দেশভাগ নিয়ে হাসান আজিজুল হকের আরেকটি গল্প 'উত্তর বসন্তে'র ওপর ভিত্তি করে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

আকরাম খান বলেন, সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের পরিমিতিবোধ, তার ধ্বনিতত্ত্বের ব্যবহার এবং সমাজের বিশাল বিশাল ক্ষতগুলোকে সহজ ভাষায় পাঠকের কাছে উপস্থাপনের ক্ষমতা তাকে তার জায়গা আলাদা করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, চল্লিশের দশকের শেষের দিকে দেশভাগের জটিল অভিজ্ঞতাগুলো হাসান আজিজুল হক অন্বেষণ করেছেন এবং জীবন ও সমাজের অপ্রয়োজনীয় এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

পাঠকদের হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিতে তিনি তার সমসাময়িক লেখকদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন এবং মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাস্তায় নেমে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বলেন তিনি।

হাসান আজিজুল হক ৮২ বছর বয়সে সোমবার রাত ৯টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিহাস আবাসিক এলাকায় নিজ বাড়ি 'উজান'-এ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় মারা যান। মঙ্গলবার দুপুর ৩টায় রাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে তাকে দাফন করা হয়।

গ্রন্থাগারের প্রবেশপথে উত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের কবর এবং দক্ষিণে হক সমাহিত আছেন।

দাফনের আগে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো কফিনে হাসান আজিজুল হকের মরদেহ মধ্যরাত থেকে বাড়ির উঠানে রাখা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১১টায় তার মরদেহ ক্যাম্পাসের দর্শন বিভাগে এবং দুপুর ১২টায় রাবি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একটি মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়।

জোহরের নামাজের পর রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

সেই জমায়েতে শত শত মানুষ— নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, কবি, আবৃত্তিকার, শিক্ষাবিদ, ছাত্র, গায়ক, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষ, রাস্তার বিক্রেতারা চোখের জলে তাকে বিদায় জানান।

হাসান আজিজুল হকের গল্প নিয়ে চলচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আকরাম খান বলেন, খাঁচা গল্পটা প্রথম পড়েই বুঝতে পারি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দেশভাগ।

'দেশভাগের ওপরে ২ বাংলা মিলে হাসান আজিজুল হকের মতো সাহিত্য খুব কম জনই রচনা করেছেন, বিশেষ করে তার "খাঁচা", "আত্মজা ও একটি করবী গাছ", "পরবাসী", "আগুনপাখি" এবং তার "ফিরে আসি ফিরে যাই", "উঁকি দিয়ে দিগন্ত" এগুলোর মতো আত্ম জৈবনিক লেখাগুলোতে দেশভাগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লেখক নিজেও দেশভাগের শিকার, তাকে দেশভাগের কারণে পিতা-মাতার ভিটা ত্যাগ করতে হয়েছে। কাজেই তার সাহিত্যে দেশভাগ একটা বড় অধ্যায়। পরবর্তীতে যখন তিনি একাত্তর দেখলেন, একাত্তর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি আবার "নামহীন গোত্রহীন" এবং "বিধবাদের কথা"র মতো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য লেখা, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের যুদ্ধ নিয়ে উনার খুব ভালো লেখা আছে'— বলেন আকরাম খান।

তিনি আরও বলেন, 'এসব কারণেই আমি হাসান আজিজুল হকের 'খাঁচা' গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য "উত্তর বসন্তে" নিয়ে কাজ করেছি, এটাও দেশভাগের ওপরে একটা গল্প এবং তারপরে আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক "বিধবাদের কথা" নিয়ে কাজ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে উনার দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভিন্ন ছিল, যেমন আমরা বলি যে বিশ্বসাহিত্যে মার্কেজের (কলাম্বিয়ান উপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ) একটা ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের ছিল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে তার লেখায় প্রান্তিক মানুষ এবং রাঢ়বঙ্গ বিশেষ স্থান পেয়েছে।"

সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের অনন্যতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, তার পরিমিতিবোধ; অল্প শব্দের মধ্যে তিনি বিশাল কিছু ধারণ করতে পারতেন, এটা একটা দিক। আরেকটি হলো তার সাহিত্যে ধ্বনির ব্যবহার, যেখানে তিনি পাখির ডাক থেকে শুরু করে মানুষের জীবন অবিকল শব্দে রূপান্তর করেছেন তার লেখাগুলোতে। এ ছাড়া, তার লেখায় ইতিহাস ও একটি বড় জনপদকে ধারণ করতে দেখি। যেহেতু সাতচল্লিশে আমরা ধর্মের কারণে বিভক্ত হয়েছি, তার সাহিত্যে বৃহৎ ভারত এবং বৃহৎ বঙ্গের ঐতিহ্যটাকে ধারণ করতে দেখি। তিনি প্রচণ্ড রকম সাম্যবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন।'

আকরাম খান বলেন, 'আশির দশকে জামায়াত-শিবির যখন প্রচণ্ড রকম তৎপরতা শুরু করেছিল তখন তিনি একদম সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে মিছিল থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। তিনি একদিকে যেমন করে সাহিত্যে উচ্চমানের সাহিত্যিক আরেকদিক থেকে রাজনৈতিক কর্মী বা অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেও উনার মতো লোক খুব কম। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে হাসান আজিজুল হকের প্রস্থান নয়। তিনি অনেক রিসোর্স রেখে গেছেন। তার প্রচুর লেখার রয়েছে যেগুলো আমাদের চর্চা করা উচিত। নানা রকম ফর্মে এই চর্চা হওয়া উচিত, থিয়েটারে এটা হওয়া উচিত, চলচ্চিত্র হওয়া উচিত এবং তার লেখার সংগ্রহ বৃদ্ধি করা উচিৎ। তাকে চর্চা করার জন্য একটা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা প্রয়োজন। এগুলো যদি আমরা করি তাহলে সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের যে উদ্দেশ্য যে মানুষের জন্য লেখা, মানুষের মঙ্গলের জন্য লেখা সেটা সার্থক হবে।'

তিনি বলেন, 'দেশ ভাগ নিয়ে যাদের লেখা পড়ি সাধারণত এপাড় বাংলা থেকে চলে যাওয়া সনাতনধর্মীদের বেদনা নিয়ে। হাসান আজিজুল হকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখি। তার লেখায় এটা ভিন্ন, মুসলমান পরিবারের এপাড়ে চলে আসার বেদনা নানাভাবে এসেছে তার লেখায়। এটা নানাভাবে এসেছে, তার আত্মজীবনীতে এসেছে, তার উপন্যাসের মধ্যে এসেছে, তার ছোট গল্পের মধ্যে এসেছে।'

হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাস থেকে উদাহরণ টেনে আকরাম খান বলেন, তিনি একজন বাস্তববাদী লেখক ছিলেন এবং তার চরিত্রগুলোর চিন্তাধারা যে পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতে পারে, তার বেশি কোনো কিছু তিনি তাদেরকে দিয়ে বলিয়ে নেননি। এখানেও তার স্বতন্ত্রতা লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, উপন্যাসের মধ্যে যে মূল নারী চরিত্রটি তিনি দেশভাগের পর দেখলেন কেউ কেউ রাঢ়বঙ্গ ত্যাগ করে পাকিস্তানে গেল কেউ কেউ গেল না, যে ছেলেরা দেশভাগ নিয়ে লাফালাফি করল তারা স্থান ত্যাগ করল না কিন্তু অন্যরা করতে বাধ্য হলো। পাকিস্তান যদি এতই কাঙ্ক্ষিত হবে তবে সবাই গেল না কেন? সাধারণ মানুষ ওই নারী এত রাজনীতি বোঝে না কিন্তু সে এটা জানে যে একটা বড় বৃক্ষকে যদি তার স্থান থেকে তুলে নিয়ে অন্যখানে রোপন করা হয় তবে সে বৃক্ষ বাঁচবে না। সেটাই সেই নারী বলতে থাকল যে তাকে পাকিস্তানে যেতে বাধ্য করলে তিনিও মারা যাবেন।

'হাসান আজিজুল হক যখন কৃষকদেরকে নিয়ে লিখছেন, প্রান্তিক মানুষ নিয়ে লিখেছেন, তার চরিত্রগুলো যে যতটুকু চিন্তা করতে সক্ষম, তাকে দিয়ে ততটুকুই বলিয়েছেন। এই পরিমিতি বোধই তাকে অমর করে রাখতে সক্ষম'— বলেন আকরাম খান।

Comments

The Daily Star  | English
sirens sound in israel after iran missile attack

Iran foreign minister to address UN Human Rights Council

Trump to decide within two weeks on possible military involvement

16h ago