ইসির অনিয়মে ২ ইউপিতে নৌকার ৪ দাবিদার

নির্ধারিত সময়ের পর জমা নেওয়া হয় মনোনয়নপত্র

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৯ ডিসেম্বর। এর আগের দিন মো. ইফতেখার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন সংযুক্ত করে মনোনয়নপত্র জমা দেন এমদাদুল হক ভূঞা।

কিন্তু পরের দিন এই চিত্র পাল্টে যায়।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর দিন ১০ ডিসেম্বর ইফতেখার হোসেন আবার মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর বদলে তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র নিয়ে আসেন। সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় শুরুতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেটা জমা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে প্রাপ্তি স্বীকার ছাড়াই জমা নেন।

স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান সময়ের পরে মনোনয়নপত্র জমা নিতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হাতে। ১২ ডিসেম্বর ইফতেখার হোসেনের দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ করে এমদাদুলের মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়।

১৭ ডিসেম্বর নৌকা প্রতীক বরাদ্দ করা হয় ইফতেখারের নামে।

এমদাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শুরুতে যখন দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন দেওয়া হয় তখন ইফতেখার সেই সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন।

'স্থানীয় এমপি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে একজন বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিনি ষড়যন্ত্র করে আমার মনোনয়ন বাতিল করিয়েছেন। হাইকোর্ট থেকে আমার মনোনয়ন বৈধ করা হয়েছে। কিন্তু আমাকে আমার প্রতীক ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।' তিনি বলেন।

শুরুতে 'বিদ্রোহী' হয়ে পরবর্তীতে নৌকা প্রতীকে প্রচারণা চালাচ্ছেন ইফতেখার। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এ বিষয়গুলো পুরনো হয়ে গেছে। তিনি এখন কেবল সামনের নির্বাচনের কথাই ভাবছেন।

একই ঘটনা পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন রাজগাতিতেও হয়েছে। সেখানে প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন আবদুর রউফ। শাহাদাত হোসেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ১০ ডিসেম্বর শাহাদাতের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। নৌকার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় রউফের নাম।

শাহাদাতের দাবি, তিনি ও এমদাদ ছাড়া নান্দাইলের বাকি সব ইউনিয়ন পরিষদে এমপি আনোয়ারুল আবেদীনের সমর্থকরা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এলাকায় একক আধিপত্য ধরে রাখতে চান বিধায় সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করিয়েছেন।

এমদাদ ও শাহাদাত দুজনই বলছেন, তারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন না। প্রতীক ফিরে পেতে শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।

তারা প্রথমে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছিলেন। নিজেদের পক্ষে রায় না পেয়ে হাইকোর্টে যান। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের একটি বেঞ্চ গত ২০ ডিসেম্বর এমদাদ ও শাহাদাতের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন।

কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত এই দুই প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা ফেরত পাননি; যদিও নির্বাচন কমিশনের সময়সূচি অনুযায়ী, আগামী ৫ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ভূইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সুপারিশ অনুযায়ীই শুরুতে দুজনকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে কেন পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটা হাইকমান্ড বলতে পারবে।

তিনি বলেন, 'লোকমুখে শুনেছি যে, এমপির তদবিরের কারণে এটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, তারা ঠিক সময়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি।'

জানতে চাইলে ওই আসনের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই ওই দুই ইউনিয়নে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী ও দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ পরিপত্র (২৭ নভেম্বর ২০২১) অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল কোনো ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিতে পারবে না। একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে উক্ত দলের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ এর ১২(৭) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি একাধিক মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করলে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক প্রাপ্ত প্রথম বৈধ মনোনয়নপত্র ব্যতীত অন্য সকল মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাবে।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশন আইনের ব্যত্যয় করে উল্টো কাজ করেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন একজন প্রার্থী দলীয় প্রত্যয়ন জমা দিবে, তখন তা মনোনয়নপত্রের অংশ হয়ে যায়। আর নির্ধারিত সময়ের পরে অন্য কোনো প্রত্যয়ন জমা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই।'

'এক্ষেত্রে পুরোটাই আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। এগুলো কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।'

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও চন্ডীপাশা ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা উচ্চ আদালতের রায়ের সার্টিফাইড কপির জন্য অপেক্ষা করছেন।

নির্ধারিত তারিখের পরে দলীয় মনোনয়ন জমা নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, 'আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই দলীয় মনোনয়নপত্রের ফটোকপি পেয়েছিলাম। সময়ের পরে মূল কপি জমা নেওয়া হয়েছে।'

কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সচিবের কাছে পাঠানো তার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দ্য ডেইলি স্টার সংগ্রহ করেছে। সেখানে নির্ধারিত সময়ে ইফতেখারের দলীয় মনোনয়নপত্র না পাওয়ায় তার পরবর্তী করণীয় কি হবে, সেটি জানতে চেয়েছেন।

চিঠির বিষয়টি উল্লেখ করলে ফখরুজ্জামান বলেন, 'প্রতীক বরাদ্দ হয়ে গেছে, এখন আদালতের রায়ে যা বলা হবে, আমরা সেভাবেই করব।'

আর রাজগাতি ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তা মশিউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইন মেনেই একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়িয়েছে। উচ্চ আদালতের অফিসিয়াল রায় আমরা এখনো পাইনি। পেলে ওই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

অন্যান্য সকল অভিযোগ তাকে জানানো হলে তিনি মুঠোফোনে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি বিষয়টি অবগত নন।

তিনি বলেন, 'যেহেতু বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়িয়েছে, আদালত যেভাবে বলবেন আমরা সেটাই করব।'

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The rules were published through a gazette yesterday, repealing the previous dress code of 2004

53m ago