চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচন: শক্ত ঘাঁটিতেও নৌকার ভরাডুবি

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত ফরিদপুর। হোক জাতীয় নির্বাচন কিংবা স্থানীয়, দুটি উপনির্বাচন ছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সব নির্বাচনে বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এখানে। কিন্তু এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত ফরিদপুর। হোক জাতীয় নির্বাচন কিংবা স্থানীয়, দুটি উপনির্বাচন ছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সব নির্বাচনে বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এখানে। কিন্তু এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।

গত রোববার অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেল, জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৯টিতে 'নৌকা' প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। এর মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা জামানত খুইয়েছেন।

২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনের ১৫টি ইউনিয়নের ১৪টিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন।

ফরিদপুর যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের করুণ অবস্থার এক খণ্ডচিত্র। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের মতো জায়গাতেও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা প্রার্থীদের করুণ অবস্থা দেখা গেছে।

২৬ ডিসেম্বর রোববার সারা দেশে ৫৮টি জেলার মোট ৮৩৬টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়। এই ধাপে ভোটের আগেই একক প্রার্থী হিসেবে ৪৮ ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা ভোটে জয় নিশ্চিত করেন। সোমবার ৮৩৬টির মধ্যে মোট ৭৯৬টি ইউনিয়নের ফল অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তত ১২০টি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। অন্তত ১১০টি ইউপিতে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন তারা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ২৮টি ইউপিতে নৌকার প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

এর মধ্যে সর্বনিম্ন ভোট পেয়েছেন কক্সবাজারের চকরিয়ায় চিরিংগা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী শাহনেওয়াজ রুমেল। মোট ১০ হাজার ৪৩৬ ভোটের মধ্যে তিনি ৬৭ ভোট পেয়েছেন। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নে ১৭ হাজার ৪৯৬ ভোটের মধ্যে নৌকার প্রার্থী হাসিনা বেগম পেয়েছেন ৯৩ ভোট।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউপিতে নৌকার প্রার্থী এস এম আনিছুজ্জামান নৌকা প্রতীক নিয়ে মাত্র ১১৮ ভোট পেয়েছেন। ইউপির মোট ভোটার ২০ হাজার ৬৮৯ জন।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের ফলাফল দলের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এবারের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সতর্ক ছিল না দল। অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূল থেকে পাঠানো নামকে উপেক্ষা করা হয়েছে। জনপ্রিয়তা যাচাই না করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, আওয়ামীবিরোধী মনোভাব, সাংসদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দলসহ নানাবিধ কারণে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন,  অনেক জায়গায় বর্তমান চেয়ারম্যানকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যারা আগের ৫ বছরে তাদের জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন।

এর বাইরে, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীদের দমন করতে নানা ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলেও ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও তারা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, কোথাও বহিষ্কার করেছে। নেতারা মনে করছেন, এত সংখ্যক বিদ্রোহীদের জয় আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করতে উৎসাহিত করবে।

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের ৩ ধাপের তুলনায় চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগ আরও খারাপ করেছে।

রোববারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৪৯ শতাংশ ইউপিতে। নৌকাও জিতেছে ৪৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ইউপিতে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে যেটা ছিল ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগ জিতেছিল যথাক্রমে ৫৬ ও ৫৩ শতাংশ ইউপিতে।

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি আবদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি দলের জন্য একটি শিক্ষা। এই শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে দল আরও ভালোভাবে কাজ করবে।'

তার ভাষ্য, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের ফলাফল দলের কাছে অপ্রত্যাশিত।

ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৯টিতে 'নৌকা' প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন, যাদের মধ্যে ৫ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই বহিষ্কৃতদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। স্থানীয় সাংসদ মনজুর হোসেন ও সাবেক সাংসদ আবদুর রহমানের মধ্যে অনুসারীদের দ্বন্দ্বের কারণেই এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।

বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীকুল মীরধা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচনের আগে আমরা স্থানীয়ভাবে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছে তাদের একটি তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলাম। সবার নামের পাশে পূর্বের বিভিন্ন নির্বাচনে কার কি ভূমিকা ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছিল।

'কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়নের তালিকার প্রথম সারির কাউকে নৌকা দেওয়া হয়নি। তাই নির্বাচনের ফলাফল এমন হয়েছে। এই ফলাফলে আমরা দুঃখিত।'

স্থানীয়দের ভাষ্য, এর আগে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও পরাজয়ের পেছনে ছিল সাবেক সাংসদ কাজী জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বর্তমান সাংসদ মজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনের নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

আওয়ামী লীগের একটি বড় ঘাঁটি কিশোরগঞ্জ। রোববার জেলার হোসেনপুর, কটিয়াদী ও ভৈরবের ২২টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টিতে হেরেছে নৌকা।

জেলায় আওয়ামী লীগের সবচেয়ে করুণ দশা কটিয়াদী উপজেলায়। সেখানে ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ জিতেছে ২টিতে।

সুনামগঞ্জ জেলার ২১টি ইউপির মধ্যে ৯টিতেই নৌকার প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। সেখানে মাত্র ৭টিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। ৬টিতে জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহীরা।

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আরেক জেলা শেরপুর। ওই জেলার শ্রীবরদী উপজেলায় ৯টি ইউপির মধ্যে ৭টিতেই হেরেছে নৌকা। ওই ৭ ইউপির ৪টিতে স্বতন্ত্র ও ২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল করিম ভেলুয়া ইউপিতে জিতেছেন; যেখানে নৌকার প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম চতুর্থ হয়েছেন।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের রামগোপালপুর ইউনিয়নে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ৩ বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়। তবুও নৌকার পরাজয় ঠেকানো যায়নি। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাশ করেছেন ২টি ইউনিয়নে। ৪টিতে স্বতন্ত্র ও ৩টিতে বিদ্রোহীরা জিতেছেন। ১টি ইউপির ফল স্থগিত আছে।

দিনাজপুরের ২১টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের অন্তত ৬ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। রাঙামাটি জেলার ১০ ইউপির মধ্যে মাত্র ১টিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ।

স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করেছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তবে, স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, চতুর্থ ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন বিএনপির ৭৫ জন নেতা।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টি জিতেছে ৬টিতে, চরমোনাইর পীরের অনুসারী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জিতেছে ২টিতে এবং জাকের পার্টি ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) জিতেছে ১টি করে ইউনিয়নে।

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

3h ago