বাংলাদেশে রেল ট্রানজিট চায় ভারত

ভারতীয় রেলওয়ের (আইআর) একটি প্রস্তাবের পর বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেল ট্রানজিট ব্যবহার করার বিস্তারিত তথ্য খতিয়ে দেখতে সম্মত হয়েছে ২ দেশ।
এই পরিকল্পনার আওতায় বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ ও হলদিবাড়ির মধ্যে ভারতীয় ট্রেন চলাচল করবে। সেক্ষেত্রে ট্রেনগুলো গেদে-দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা) সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং চিলাহাটি (নীলফামারী)-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছাবে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতে সড়ক পরিবহনের সুবিধা রয়েছে। উভয় দেশের সরকারের অনুমোদন পেলে প্রস্তাবিত রুটটি অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পরে ২ দেশের মধ্যে প্রথম রেল ট্রানজিট সুবিধা হবে।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের আগে ২ দেশের মধ্যে ৮টি ইন্টারচেঞ্জ সুবিধা ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি চালু রয়েছে। সেগুলো হলো—বেনাপোল-পেট্রোপোল, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিংবাধ, বিরাল-রাধিকারপুর ও চিলাহাটি-হলদিবাড়ি।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশ রেলওয়ের (বিআর) সঙ্গে এক বৈঠকে এ প্রস্তাব দেয় ভারতীয় রেলওয়ে।
সভার নথিতে থেকে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, রুটের অবকাঠামো গেদে-দর্শনা-ঈশ্বরদী-আবদুলপুর-পার্বতীপুর-চিলাহাটি-হলদিবাড়ি থেকে ট্রেন চালুর জন্য 'পুরোপুরি প্রস্তুত'।
বৈঠকে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে দর্শনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত একটি নতুন রাত্রিকালীন ট্রেন পরিষেবা চালু করার কথা বলেছিলেন। ঢাকা শিগগিরই এ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করবে বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
মালবাহী ট্রেন ছাড়াও বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে।
বর্তমানে মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে চলাচলে ইন্টারচেঞ্জ হিসেবে গেদে-দর্শনা ব্যবহার করছে। বন্ধন এক্সপ্রেস চলাচল করছে খুলনা ও কলকাতার মধ্যে।
৫৫ বছরের বিরতির পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে ২ দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ পুনরায় শুরু হয়। তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালি এক্সপ্রেস আজ থেকে পুনরায় চালু হয়েছে।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে ট্রেন চলাচল পুনরায় চালু হওয়ায় বাংলাদেশ হয়ে পুরনো শিলিগুড়ি-শিয়ালদহ রুটও পুনরায় চালু করার কথা ভাবছে ভারতীয় রেলওয়ে।
প্রস্তাবিত ট্রানজিট সুবিধাটি ভ্রমণের সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা কমিয়ে আনবে। বর্তমানে ভারতীয় ট্রেনগুলোকে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছানোর জন্য ৫৭৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এটি যদি নতুন রুট দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে, তবে সেটি ২০০ কিলোমিটারে নেমে আসবে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের আগে শিলিগুড়ি থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো হলদিবাড়ির মধ্য দিয়ে যেত এবং কলকাতার পথে পূর্ব পাকিস্তানের চিলাহাটিতে প্রবেশ করত।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এই লাইনটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রস্তাব
বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের ভারত সফর পরিকল্পনার সূত্র ধরে এপ্রিলে বাংলাদেশ সফর করে ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক (ট্রাফিক পরিবহন) মনোজ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল।
রেলমন্ত্রী শনিবার ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন এবং শুক্রবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
গত ২১ এপ্রিল ঢাকার রেলভবনে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসানের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে ভারতীয় দল।
বৈঠকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ট্রেন চালু হলে তা উভয় দেশের রেলওয়ে, জনগণ ও বাণিজ্যের জন্যেই লাভজনক হবে।
নথিতে আরও উল্লেখ রয়েছে, উভয় পক্ষই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য বের করতে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিতে সম্মত হয়েছে। এটি ভারতীয় রেলওয়ের জন্য ভিড় কমাতে এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে আয় করতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বৈঠকে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভারতীয় রেলওয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি একটি বড় ইস্যু এবং এটি নিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করা দরকার।'
এ বিষয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান। মন্তব্য করেননি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারও।
ভারতীয় প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে এসেছে যখন সেখানকার একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় সরকার একটি দ্বিতীয় রেলপথের কথা ভাবছে, যা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়কে বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
ভারতীয় রেলওয়ে সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য টেলিগ্রাম অনলাইনের গত ৫ মের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির অনুমোদন চেয়ে সম্প্রতি দেশটির উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের কাটিহার বিভাগ রেলওয়ে বোর্ডের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই রেলপথটি হিলি থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঘোড়াঘাট, পলাশবাড়ী ও গাইবান্ধার মতো স্থান দিয়ে যাবে এবং তুরার মহেন্দ্রগঞ্জকে সংযুক্ত করবে।
অন্যান্য বিষয়
বৈঠকে বাংলাদেশে বিভিন্ন ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টের প্রতিটিতে মাসে অন্তত আরও ১০ থেকে ১৫টি ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টিও তুলেছে ভারত।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে কিছু পরিমাণ ট্রেন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও কাউনিয়া-লালমনিরহাট অংশকে মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরসহ কয়েকটি প্রকল্প নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারতীয় রেলওয়ে।
আর বাংলাদেশ রেলওয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বুড়িমারী-চেংরাবান্ধালিংক পুনরুদ্ধার এবং পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা-রাঙ্গাপানি (ভারত) সংযোগ স্থাপনে।
Comments