বিটিআরসির ডানা ছাঁটতে তৈরি সরকার

btrc logo

সরকার যদি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের পরিকল্পিত সংশোধনের ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রাখে, তাহলে নিয়ন্ত্রক কমিশনের সব স্বাধীনতা আর ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিষয়টি একটা সময়ে টেলিকম খাতের বিকাশের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক হয়ে উঠবে। অথচ বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে।

টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত সব বিষয় নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরির উদ্দেশ্যে টেলিকম আইনের অধীনে ২০০২ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গঠিত হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২১ এর খসড়া বিটিআরসির সঙ্গে সম্পর্কিত 'স্বাধীন' শব্দটি সরিয়ে দিয়েছে।

এতে করে বিটিআরসিকে তার বেশিরভাগ ক্ষমতা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দিতে হবে। সংস্থাটি দ্রুত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এ জন্য তাকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

২০০১ সালে কার্যকর হওয়া মূল আইনে বলা আছে, কমিশন টেলিযোগাযোগ পরিষেবার নানা ধরনের লাইসেন্স ইস্যু ও বাতিলের পাশাপাশি ওয়্যারলেস তরঙ্গ বরাদ্দ করতে পারবে। সেই সঙ্গে টেলিকম পরিষেবার কলচার্জ ও ট্যারিফ নির্ধারণসহ নানা কিছু করতে পারবে।

এর আগে ২০১০ সালে একটি সংশোধনীর মাধ্যমে বিটিআরসির এসব ক্ষমতা আংশিকভাবে হ্রাস করা হয়। ওই সংশোধনী অনুসারে বিটিআরসিকে এখন লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, হস্তান্তর কিংবা বাতিল এবং বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়।

কিন্তু ২০২১ সালের সংশোধনীর খসড়া আগের তুলনায় আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে। এ ক্ষেত্রে নতুন সংশোধনী কার্যকর হলে বিটিআরসি যা যা করতে চায়, তার প্রায় সবকিছুর জন্যই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।

এ ছাড়াও লাইসেন্স ও স্পেকট্রাম থেকে অর্জিত রাজস্ব পাঠাতে হবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। যে রাজস্ব এখন বিটিআরসির কাছে রাখার বিধান আছে।

সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনারদের বাইরে বিটিআরসি এখন প্রতিটি গ্রেডের কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের পদোন্নতি কিংবা বদলির সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়ে থাকে।

কিন্তু নতুন সংশোধনীর খসড়া অনুসারে, কমিশনের চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি কিংবা শাস্তি প্রদানের সব ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের।

বিপরীতে কমিশন কেবল নিচের স্তরের দশম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শাস্তির সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

সেই সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনে প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান আর সরকারি আদেশ (জিও) জারি করতে পারবেন না।

মূল আইন অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা কমিশনারের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ তদন্ত করতে পারেন। দোষী প্রমাণিত হলে তাকে সরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সংশোধনীর খসড়ায় এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়কে।

বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টেলিযোগাযোগ আইন যদি এভাবেই সংশোধন করা হয়, তাহলে বিটিআরসির মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে।'

তার অভিমত, এমন হলে টেলিযোগাযোগ খাতটি চলে যাবে আমলাতন্ত্রের হাতে। আর এর কার্যক্রমে কোনো স্বচ্ছতা থাকবে না।

কলম্বোভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক সংস্থা লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান জানান, আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সর্বশেষ নিয়ন্ত্রক সূচক অনুসারে এশিয়ার ২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে চার ধাপ, ভুটানের চেয়ে সাত ধাপ ও পাকিস্তানের চেয়ে ১২ ধাপ পিছিয়ে।

এই টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এই সংশোধনী বাংলাদেশকে আরও পিছিয়ে দেবে। কারণ আমলারা বিটিআরসি থেকে নিয়ন্ত্রক কাজগুলো ছিনতাই করছে। দেশের অন্যান্য সূচকগুলোর উন্নতির সঙ্গে এটা অপমানসূচক বৈপরীত্য।'

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার জানান, টেলিযোগাযোগ বিভাগের আহ্বান অনুসারে তারা এর মধ্যে তাদের মতামত জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি কমিশনকে কমিশনের মতোই কাজ করতে দেওয়া হবে।'

টেলিযোগাযোগ আইন বিশেষজ্ঞ তানজীব-উল-আলমের মতে, এই শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ ও বাধা রয়েছে তা খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়নি। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এসব নতুন নতুন ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য খসড়া আইনে কোনো নিয়ম বা নির্দেশনা নেই।

তানজীব-উল-আলম বলেন, 'উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই আইনে কিছুই রাখা হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এটা কীভাবে কাজ করবে তার স্পষ্ট কোনো ধারণা এখানে অনুপস্থিত।'

চলতি আইনের খসড়া তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই বিশেষজ্ঞের মতে, নতুন খসড়া আইনের পুরোটাই কমিশনের স্বাধীন মর্যাদা অস্বীকার করে এই খাতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করেছে।

আবার প্রস্তাবিত কিছু সংশোধনী বিদ্যমান অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করলেও বেশিরভাগ বিধান কমিশনের মর্যাদা হ্রাস ও সংস্থাটিকে মন্ত্রণালয়ের একটা বিভাগে পরিণত করার উদ্দেশ্য থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন- আটক করার ক্ষমতা সম্প্রসারণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা।

এ ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে (ধারা ৮৯বি) প্রস্তাবিত সংশোধনী বিদেশি বা স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য মোটেও উৎসাহজনক নয়।

'সংশোধনীর পুরো পরিকল্পনার সবচেয়ে আপত্তিকর অংশ হলো, সরকার এখানে স্বার্থের সংঘাত এড়ানোর ধারণাটিই পরিত্যাগ করেছে। প্রস্তাবিত এই সংশোধনীর বাস্তবায়ন হলে সরকার একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক (অপারেটর) হয়ে যাবে,' যোগ করেন তানজীব-উল-আলম।

অবশ্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২১ এর খসড়ায় আনা পরিবর্তনগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'বিটিআরসি যদি সরকারে অধীনে থাকে তাহলে ক্ষতি কি? সরকার অথবা মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে বিটিআরসি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এটা উচিতও না। সরকার ছাড়া কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করতে পারে না।'

মন্ত্রীর অভিমত, কমিশন এখন অতিরিক্ত কর্তৃত্ব ভোগ করছে।

স্বায়ত্তশাসন কাজে লাগিয়ে বিটিআরসি অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগের পাশাপাশি কর্মীদের ইচ্ছেমতো পদোন্নতি দিয়েছে, বদলি করেছে মন্তব্য করে মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, 'আমরা এই সংস্থাকে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করতে দেখেছি। বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে।'

তার অভিমত, এসব কার্যক্রমকে একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনার জন্যই এই সংশোধনী। এ ছাড়া মন্ত্রী মনে করেন, টেলিযোগাযোগের মতো গতিশীল একটা খাত ২০ বছরের পুরনো আইন দিয়ে কার্যকরভাবে চলতে পারে না। তিনি বলেন, 'এ জন্যই আমরা আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি।'

অবশ্য টেলিকম বিশেষজ্ঞ তানজীব-উল-আলমের পর্যবেক্ষণ হলো, 'জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টেলিযোগাযোগ খাতে যে দ্রুত পরিবর্তনগুলো ঘটে চলেছে তার সঙ্গে এই খসড়া সংশোধনী সঙ্গতিপূর্ণ মনে হচ্ছে না। বরং এটি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ক্ষমতাগুলো কুক্ষিগত করার দিকে ঝুঁকেছে। যা একটা অশুভ নিদর্শন।'

 

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
2001 Ramna Batamul attack

HC fixes May 8 for verdict on Ramna Batamul bomb blast

On April 14, 2001, two bombs went off during 1408 Pahela Baishakh celebrations, leaving 10 dead, many injured

1h ago