মাতৃত্বকালীন পুষ্টির অভাবে চা-শ্রমিক মায়েরা
পরিবারে নিজেদের অর্থনৈতিক অবদান থাকলেও, মাতৃত্বকালীন পুষ্টির অভাবে ভুগতে হয় চা-বাগানের নারী শ্রমিকদের। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী সময় পর্যন্ত যতটুকু পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যগত পরিচর্যা এবং বিশ্রাম প্রয়োজন, আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও সচেতনতার অভাবে এর কিছুই পান না তারা। অন্যদিকে বাল্যবিয়ে ও অধিক সন্তান ধারণের প্রবণতার কারণে চা শ্রমিক মা এবং তাদের সন্তানদের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতাসহ নানারকম শারীরিক জটিলতায় ভুগতে হয়।
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার নারী শ্রমিক কাজল রায়ের ৪ মেয়ে। কাজল রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছেলের শখ ছিল। কিন্তু পরপর ৪টা মেয়ে হয়েছে। স্বামীরা বুঝতে চায় না। বলে, থাক না ৫-৬টা। কিন্তু খাওয়াতে তো পারে না।'
'দিনে ১২০ টাকা রোজগার করি, সঙ্গে রেশন পাই। ৫০ টাকা চালের কেজি। মায়েরা আর আলাদা কি খাবে। পেটে বাচ্চা থাকলে তখন তাদের খাবার বেশি দরকার। কিন্তু খেতে পারে না,' বলেন তিনি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাজরা পাড়া এলাকাতে ৮-১০ জন চা-শ্রমিক মায়ের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তাদের বেশিরভাগেরই সন্তান জনের বেশি। আর চেহারায় হাড় ভাঙা খাটুনি ও পুষ্টিহীনতার ছাপ।
চা-শ্রমিক রামপতিয়া হাজরার (৫২) ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলে। তিনি বলেন, 'বাচ্চা হওয়ার সময় আলাদা কিছু খাইনি।'
মীরা হাজরার (৪০) ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সপ্তাহে একদিন বাগানের হাসপাতালে মিডওয়াইফ প্রেসার মাপে। ২-৪টা আয়রন ট্যাবলেট দেয়। শাক-সবজি, ডিম-মাছ-মাংস খেতে বলে। গরিব মানুষ এগুলো কই পাবো!'
পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের মা মঞ্জু হাজরা (৪০) বলেন, 'পরিকল্পনাকর্মীরা সভায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। কিন্তু এটা কেউ মানতে পারে না।'
৪ মেয়ের মা জামাতি হাজরা (৩৫) বলেন, 'ছেলের আশায় আশায় ৪টা মেয়ে হয়েছে। মেয়েদের তো বিয়ে হয়ে যাবে। ১টা ছেলে হলে ঘরে থাকত। মুখে এক গ্লাস পানি দিব। এজন্য সবাই একটা হলেও ছেলে চায়।'
নারীদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ চা-শ্রমিক দেবীয়া হাজরা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যার শক্তি থাকে, পয়সা-কড়ি থাকে সে অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু চা-বাগানের সবারই একই অবস্থা। তবু যারা সচেতন, তারা একটু যত্ন করে।'
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের আহ্বায়ক খায়রুন আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে অসুস্থতা ও স্যানিটেশন দুটোর অবস্থাই খারাপ। পিরিয়ডিক ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। এক কথায় বলা যায়, চা-বাগানে প্রজনন স্বাস্থ্য খুব ভালো না। অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা, জননেন্দ্রীয় সংক্রমণ প্রকট। এর বড় কারণ অর্থনৈতিক। মা রোজগার করে, ভাগ পায় পরিবারের সবাই। বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেশি। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর পুষ্টি ব্যবস্থাপনা খারাপ।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক এনজিওকর্মী বলেন, 'অনেক চা-বাগানে বাল্য বিয়ে বাড়ছে। একেকজনের ২-৩টা মেয়ে। মেয়ে বড় হয়েছে। বাসায় বড় মেয়েদের রেখে কাজে যেতে নিরাপত্তার অভাব।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে কিছু মেয়ে লেখাপড়া করছে। তারা চলাফেরা শিখেছে। এজন্য মেয়েদের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কম বয়সে বিয়ের কারণে বাচ্চা হচ্ছে। আর্থিক কারণে খেতে পায় না বলে অপুষ্টিতে ভুগছে মায়েরা।'
সিলেট বিভাগের চা বাগানের ওপর জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল ২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়।
এতে দেখা যায়, চা বাগানের মোট ৪৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার। আর ১৮ বছর বয়সের আগে মা হয়ে যাচ্ছে ২২ দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী।
সিলেটের চা বাগানে কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষার পরিচালক নিগাত সাদিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাল্যবিবাহ চা শ্রমিক মেয়েদের জন্য অনেকটা ভাগ্যের মতো। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। অল্প বয়সেই তারা মা হয়ে যাচ্ছেন। আর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অপুষ্টিতে ভুগছেন এই মায়েরা।'
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক নারী ফোরামের আহবায়ক ও কমলগঞ্জ উপজেলার কুরমা চা-বাগানের গীতা রানি কানু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা-বাগানে মায়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই নাজুক। পাহাড়-জঙ্গলে কাজ করা এই মায়েরা প্রয়োজনীয় খাবার পান না। এখানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম কম। বেশি বাচ্চা নেওয়ার কারণে তাদের শরীর ভেঙে পড়ে। বাগানের হাসপাতালে কম্পাউন্ডার আছে। বাইরের হাসপাতালে গেলে গরু বেচতে হয়, নয়তো এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়।'
শ্রীমঙ্গল উপজেলার খাইছড়া চা-বাগানের হেলথ প্রোভাইডার বিনয় সিং রাউতিয়া বলেন, 'মায়েরা হাসপাতালে গিয়ে প্রসব করাতে চান না। তাদের কাছে এটা লজ্জাজনক। বলে কয়েও হাসপাতালে পাঠানো যায় না। ১০০ জনের মধ্যে হয়তো ১০ জন যায়। অপরিষ্কার পরিবেশে বাচ্চা হচ্ছে। নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।'
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা-বাগানের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারে না বেশিরভাগ চা-শ্রমিক। গর্ভধারণের পর চেকআপ করায় না। এছাড়া এখনো নানা কুসংস্কার আছে।'
'১২০ টাকা মজুরি দিয়ে মায়েদের পুষ্টিকর খাবার দূরে থাক, স্বাভাবিক খাবারই জোগাড় করা সম্ভব হয় না,' যোগ করেন তিনি।
জানতে চাইলে চা-বাগান মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান গোলাম মো. শিবলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগানের হাসপাতালে ডাক্তার আছে, মিডওয়াইফ ও দাই আছে। জটিলতা হলে প্রয়োজনে সিলেট হাসপাতালেও পাঠানো হয়। শ্রম আইন অনুযায়ী আমরা সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। তবে নারী চা শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব আছে।'
যোগাযোগ করা হলে সিলেটের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মোহাম্মদ নূরে আলম শামীম বলেন, 'চা বাগানে ও হাওড়ে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, নবজাতকের মৃত্যু, গর্ভপাত ও গর্ভপাতের প্রবণতা বেশি থাকায় বিভাগের মোট অনুপাত বেড়ে যায়।'
এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে চা বাগানের কার্যক্রম বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ স্ট্যাটিসটিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ১৬৬টি চা বাগানে ১ লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ জন শ্রমিক কাজ করেন।
সিলেট বিভাগের ৩ জেলায় ১৩৫টি চা বাগান আছে। এসব বাগানে ৪৬ হাজার ৪৫০ জন নিবন্ধিত নারী শ্রমিক এবং ১৫ হাজার ১৫৩ জন নৈমিত্তিক নারী শ্রমিক কাজ করেন।
Comments