‘মালিকহীন ও ভারতীয়’ ২২ গরুর ‘মালিক’ ৪ খামারির কান্না

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চার জন গরুর খামারি দাবি করেছেন, গত ১৪ জুলাই রাজশাহীর রাজাবাড়ীতে বিজিবি, কাস্টমস ও পুলিশের যৌথ চেকপোস্টে ‘মালিকহীন’ ও ‘ভারতীয়’ হিসেবে যে ২২ টি গরু জব্দ করা হয়েছিল সেগুলোর মালিক তারা।
রাজশাহীর রাজাবাড়ীতে বিজিবি, কাস্টমস ও পুলিশের যৌথ চেকপোস্টে ২২ টি গরু জব্দ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চার জন গরুর খামারি দাবি করেছেন, গত ১৪ জুলাই রাজশাহীর রাজাবাড়ীতে বিজিবি, কাস্টমস ও পুলিশের যৌথ চেকপোস্টে ‘মালিকহীন’ ও ‘ভারতীয়’ হিসেবে যে ২২ টি গরু জব্দ করা হয়েছিল সেগুলোর মালিক তারা।

খামারিরা বলছেন, গরুগুলো ভারত থেকে আনা হয়নি। সেগুলোর কয়েকটি স্থানীয় খামারগুলোতে লালন-পালন করা। বাকিগুলো বিভিন্ন হাটবাজার থেকে কেনা হয়েছিল।

তাদের অভিযোগ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে গরুগুলো চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, চেকপোস্টে কোনো টাকা না দেওয়াতে গরুগুলো জব্দ করে কর্তৃপক্ষ।

খামারিদের ভাষ্য, গরুগুলো জব্দ করার পর থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে এর মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে কোনো লাভ হয়নি। আটকের পরদিন ১৫ জুলাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অন্তত ২১ লাখ টাকা মূল্যের গরুগুলো নিলামে তুলে মাত্র নয় লাখ ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়।

ঈদের আগে গরু হারিয়ে এই চার খামারিসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৩ জন কৃষকের ঘরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সান্ত্বনা দিতে তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

চোরাচালান প্রতিরোধে গঠিত রাজশাহীর আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সচিব সাধন কুমার কুণ্ডু জানান, ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার তার কাছে দায়ের করা চার জন খামারির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসকরা সেখানে বক্তব্য রাখেন। বিজিবি ও কাস্টমস কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তবে, সভায় এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

সাধন কুমার কুণ্ডু কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট রাজশাহীর যুগ্ম কমিশনার। তার বক্তব্য, বিজিবি সদস্যরা ১৪ জুলাই ‘মালিক বিহীন ও ভারতীয়’ হিসেবে ২২টি গরু স্থানীয় কাস্টমস অফিসে জমা দেন। পরে সেখানকার কাস্টমস কর্মকর্তারা নিয়ম অনুযায়ী দুই কিলোমিটার এলাকায় মাইকিং করে গরুগুলো নিলামের ব্যবস্থা করেন। পরদিন অনুষ্ঠিত নিলামে অন্তত ১৬৫ জন অংশ নেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে গরুগুলো বিক্রি করা হয়।

যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী বিজিবির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাব্বির আহমেদ খামারিদের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রাজাবাড়ি চেকপোস্ট অতিক্রম করার সময় গরু বহনকারী ট্রাকটিকে থামতে বলা হয়। তখন ট্রাক থামিয়ে আরোহীরা সবাই পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় মালিকহীন অবস্থায় তারা ট্রাকটি আটক করেন।’

সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘গরু দেশি হোক বা চোরাচালানি হোক- সেগুলো পরিবহনের সময় কাগজপত্র সঙ্গে রাখার নিয়ম আছে। হাট থেকে কেনা হলে কেনার রশিদ বা খামারে লালন করা হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের রশিদ থাকতে হয়। চোরাচালানি হলে কাস্টমস করিডোরের রশিদ নিতে হয়। সেগুলোর কোনকিছুই গরুগুলো পরিবহনের সময় পাওয়া যায়নি।’

সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘ওই গরুগুলো ছাড়া আর কোনো ট্রাকই তো আটকানো হয়নি। সবাই বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে গরু পরিবহন করেছে। পরে মালিকানা দাবি করলে তো হবে না। পরিবহনের সময় কাগজপত্র থাকতে হবে।’

ক্ষতিগ্রস্ত চার খামারির একজন হচ্ছেন সাদিকুল ইসলাম। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য। তিনি জানান, ২২টি গরুর মধ্যে ১০টির মালিক তিনি ও তার অংশীদার আব্দুর রহিম। আটটির মালিক একই ইউনিয়নের সেলিম। বাকি চারটি গরুর মালিক সেলিমের বাবা মইদুল।

খামারিরা বলছেন, সেলিমের গরুগুলো আশপাশের হাটগুলো থেকে কেনা। মইদুলের চারটি গরুর মধ্যে একটি নিজের পালিত। বাকি তিনটি তিনি স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া এবং বিক্রির পর মূল্য পরিশোধের কথা ছিল। আর সাদিকুল ইসলাম ও তার অংশীদার রহিম তাদের দশটি গরুর মধ্যে চারটি ছয় মাস ধরে পালছিলেন। বাকি ছয়টি স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে নিয়েছিলেন।

সাদিকুল জানান, ১৪ জুলাই দুপুরে বাঙ্গাবাড়ী বিজিবি ক্যাম্পের সামনে থেকে তারা গুরুগুলো ট্রাকে তোলেন। ট্রাকে চারজন খামারিসহ মোট সাত জন ছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, তারা ২০ জুলাইয়ের মধ্যে গরুগুলো বিক্রি করে ফিরে আসবেন।

আজ মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় সাদিকুল ইসলাম কেবল কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, ‘রাজবাড়ী চেকপোস্টে থামতে বলা হলে আমি ট্রাক থেকে নেমে বিজিবি সদস্যদের ২২টি গরুর কাগজপত্র দেখাই। তখন একজন কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ‘এগুলো কে দেখতে চেয়েছে?’।’

সাদিকুল আরও বলেন, ‘সেখানে আমাদের কেউ টাকার কথা বলেনি। তবে তাদের আচরণে মনে হয়েছি যে তারা টাকা চায়। কিন্তু, কত দিতে হবে সেটা বলেনি।’

সাদিকুলের বক্তব্য, ‘বিজিবি অফিসে আমাদের কথা কেউ শুনতে চায়নি। গেট থেকে বলা হয়েছে করোনার সময়ে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ। কাস্টমস অফিসে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু, তারা নিলাম থামায়নি। বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’

অবশ্য কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট রাজশাহীর যুগ্ম কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু বলছেন, ‘কাস্টমস অফিসে দায়ের করা খামারিদের অভিযোগের বিষয়টি তার নজরে আসেনি।’

তিনি জানান, অভিযোগ পেলে তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। তদন্তে মালিকানা প্রমাণ হলে অন্তত নিলাম থেকে পাওয়া টাকা প্রকৃত মালিকদের দেওয়ার বিধান আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Will there be any respite from inflation?

To many, especially salaried and fixed-income individuals, this means they will have no option but to find ways to cut expenditures to bear increased electricity bills.

7h ago