যখন গণপরিবহন বাড়ানো দরকার, তখন কমছে

স্টার ফাইল ফটো

যানজট কমানো ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে একটি পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থার পক্ষে অনেকদিন থেকে কথা বলছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ঢাকায় বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

গত দেড় বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা মহামারিকালে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।

সড়কগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাসের সংখ্যাও গত তিন বছর ধরে কমেছে। তবুও এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা এ বছর আবার বেড়েছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, 'যখন উন্নত দেশগুলো গণপরিবহন ভিত্তিক উন্নয়নের দিকে আগাচ্ছে, আমরা সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছি।'

এরকম একটি স্ববিরোধী পরিস্থিতিতে আগামীকাল দেশে বিশ্ব গাড়ি মুক্ত দিবস পালিত হবে। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো এবং এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।

দিবসটি ১৯৭০ সাল থেকে ইউরোপে এবং ২০০৬ থেকে বাংলাদেশ পালিত হচ্ছে।

গত বছর ২ হাজার ৩৯৫টি বাস বিআরটিএতে নিবন্ধিত হয়, এর মধ্যে ১ হাজার ৭৯২টি ঢাকায়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ৮ মাসে সারা দেশে মাত্র ১ হাজার ৭৫টি বাসের নিবন্ধন হয়েছে, যার ৮৪৯টি ঢাকায়।

গত বছর সারা দেশে মোট ৬২০টি মিনিবাসের নিবন্ধন হয়েছে, যার ১৩৩টি ঢাকায়। কিন্তু এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ২২০টি বাসের নিবন্ধন হয়েছে, যার মধ্যে ৯৭টি ঢাকায়।

ইতোমধ্যে, ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা এ বছরও বেড়েছে।

গত বছর সারা দেশে ১২ হাজার ৪০৩টি ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন হয়, যার মধ্যে ১১ হাজার ১৫০টি ঢাকায় ছিল। তবে এ বছর এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৪৭০টি গাড়ির নিবন্ধন হয়, যার মধ্যে ৮ হাজার ৩৯৬টি ঢাকায়।

২০২০ সালে সর্বমোট ৩ লাখ ১১ হাজার মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয় সারা দেশে, যার মধ্যে ৭৮ হাজার ৫৫১টি ঢাকায়। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে, যার মধ্যে ৫৪ হাজার ১৩৯টি ঢাকায়।

ঢাকা শহরে যানজট এখনো অন্যতম প্রধান সমস্যা। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে গত ১০ বছরে যানবাহন চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

কেন এই স্ববিরোধী উন্নয়ন?

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে করোনাভাইরাসের কারণে আরোপিত লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করেন।

তিনি জানান, বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে রুট পারমিট স্থগিত রাখাও একটি কারণ।

তবে বিশেষজ্ঞরা বাসের সংখ্যা ও সেবার মান কমে যাওয়ার পেছনে পরিকল্পনা ও উপযুক্ত নীতিমালার অভাবকে দায়ী করেছেন।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান জানান, শহরে যাতায়াতের উপযুক্ত মাধ্যম নির্ধারণের জন্য ট্রিপ লেংথ ডিস্ট্রিবিউশন ফাংশান (টিএলডিএফ) ব্যবহার করা উচিত।

এই মডেলে যাতায়াতের উপযুক্ত মাধ্যমে চিহ্নিত করার জন্য অরিজিন জোন (যাত্রা শুরুর এলাকা) ও ডেসটিনেশন জোন (গন্তব্য) বিবেচনা করা হয়।

গত বছরে বুয়েটের একটি সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শহরের টিএলডিএফ প্যাটার্ন হচ্ছে, ৭০ শতাংশ ট্রিপ গণপরিবহন ও পায়ে হাঁটার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে এবং মাত্র ৫ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ও ২৫ শতাংশ অন্যান্য নন-মটোরাইজড যানবাহনের মাধ্যমে হচ্ছে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ কারণে আমাদের গণপরিবহন ও ফুটপাথের উন্নয়নের ওপর আরও জোর দেওয়া উচিত।'

তিনি আরও জানান, যেহেতু ঢাকায় সড়কের সংখ্যা বাড়ানোর খুব একটা সুযোগ নেই, নীতিমালায় পরিকল্পিত গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত, কিন্তু সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা, যেমন সহজ শর্তে গাড়ি কেনার ঋণ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো প্রকারান্তরে আরও বেশি মানুষকে গাড়ি কেনায় উৎসাহিত করছে।

তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন বিআরটিসির বাস সেবাকে নতুন করে সাজানোর জন্য। এছাড়াও কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আওতায় সব বাসকে এনে বাস ফ্র্যাঞ্চাইজ প্রক্রিয়া চালু করা এবং বাস র‍্যাপিড ট্রান্সপোর্ট (বিআরটি) সেবাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রস্তাব দেন তিনি।

তিনি আরও জানান, ফুটপাথকে ব্যবহারযোগ্য রাখা এবং সাইকেল চালানোর জন্য অবকাঠামোর উন্নয়নও যানজট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস উদযাপনের মূল দায়িত্বে আছে।

দেশে কেন গণপরিহনের ভূমিকাকে ছোট করে দেখা হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তরে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, 'আমরা গণপরিবহনের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই দিবসটি পালন করছি।'

বাস ফ্র্যাঞ্চাইজ প্রক্রিয়া ও বাস রুট রেশনালাইজেশন চালু হলে গণপরিবহন খাতে বড় ও দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে বলে তিনি দাবি করেন।

এই প্রক্রিয়া চালুর ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রস্তুতিমূলক কাজের' জন্য সময় বেশি লাগছে।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

2h ago