যানবাহন মালিক-চালকদের সঙ্গে সরকারের আবারও আপস

পরিবহন সংগঠনগুলোর চাপের মুখে যথাসময়ে যানবাহনের কাগজপত্র হালনাগাদ করতে ব্যর্থ হওয়া মালিক-চালকদের জরিমানা আবারও মওকুফ করেছে সরকার।
গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যানবাহন চালকরা এই সুবিধা ভোগ করবেন।
যানবাহনের মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ, ট্যাক্স টোকেন, রুট পারমিট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য জরিমানা দিতে হয়।
সরকার গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো এই জরিমানা মওকুফ করল। যার ফলে কাগজপত্র হালনাগাদ করতে ব্যর্থ হওয়া মালিক-চালকরা চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাদ দিয়ে প্রায় ২ বছর এই সুবিধা ভোগ করবেন।
২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যেও কয়েকবার জরিমানা মওকুফের এমন ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আগের ৩টি বিজ্ঞপ্তির প্রতিটিতে উল্লেখ করা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে এটাই জরিমানা মওকুফের সর্বশেষ ঘোষণা। তবে গতকালের বিজ্ঞপ্তিতে এ ধরনের কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
আগের ৩ দফায় মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরিবহন মালিকদের মধ্যে প্রচারের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্দেশ দেয়। এমনকি চলতি বছরের শুরুর দিকে জুনের মধ্যে যানবাহন মালিকদের জরিমানা ছাড়াই মেয়াদোত্তীর্ণ নথিপত্র হালনাগাদ করার আহ্বান জানিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
গতকাল এমন একটা সময়ে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলো, যার কয়েক সপ্তাহ আগে জরিমানা মওকুফসহ ১৫ দফা দাবিতে ২ দিনের ধর্মঘট পালন করে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের একাংশ।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবশেষ সিদ্ধান্তটি আসলে পরিবহন সংগঠনগুলোর তদবির ও বিক্ষোভের ফলাফল। অনেক পরিবহন মালিক ও চালক সময়মতো কাগজপত্র হালনাগাদ করেন না। কারণ তারা জরিমানা মওকুফের জন্য এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।'
'ফলে হালনাগাদ কাগজপত্র পরিদর্শন ছাড়াই লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনগুলো সড়কে চলতে থাকে। তাই দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমে না', যোগ করেন সামাজিক আন্দোলন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানান, ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক ও চালকদের কাগজপত্র হালনাগাদ থাকে। কিন্তু বাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না।
পরিবহন সংগঠনগুলোর নেতা ও বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কে চলাচলরত সাড়ে ৪ লাখ বাস, ট্রাক ও লরির মধ্যে অনেক যানবাহনের সঠিক কাগজপত্র নেই।
যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, লকডাউনের কারণে অনেক যানবাহন মালিক কাগজপত্র হালনাগাদ করতে পারেননি। সবশেষ ছাড় তাদের এই সুযোগটা করে দেবে।
তার দাবি, সরকার পরিবহন সংগঠনগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি।
ছাড়ই যখন নিয়ম
জরিমানা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বাস্তবায়ন প্রতিরোধে ধর্মঘটে যাওয়া পরিবহন শ্রমিকদের অন্যতম দাবি ছিল।
নতুন আইনে মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজপত্রের জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়।
সরকার গত বছরের ২০ জানুয়ারি পরবর্তী জুন মাস পর্যন্ত জরিমানা মওকুফ করে। পরে এই সুযোগ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
বিআরটিএর এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা জুনের পর এই সময়সীমা আর বাড়াতে চাইনি। ১ জুলাই থেকে আজ (৭ অক্টোবর) পর্যন্ত আমরা জরিমানা নিয়েছি। কিন্তু সম্প্রতি ধর্মঘটের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।'
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, করোনাভাইরাসজনিত নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেকে জরিমানা অব্যাহতির এই সুবিধা নিতে পারেনি।
পরিবহন মালিকদের এই নেতা ও এনা ট্রান্সপোর্টের মালিক বলেন, 'আমাদের দাবি অযৌক্তিক না। যখন আরও অনেকে কাগজপত্র হালনাগাদ করবে, তখন সরকার লাভবান হবে।'
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি রুস্তম আলী খানও বলেন, লকডাউনের কারণে সমিতির অনেক সদস্য নথিপত্র হালনাগাদ করতে পারেননি।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের মতে, লকডাউনের সময় বিআরটিএ কার্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। ফলে চাইলেও যানবাহন চালকদের জন্য কাগজপত্র হালনাগাদ করাটা অসম্ভব ছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পরেই সবশেষ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
জরিমানা মওকুফসহ অন্যান্য দাবিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইম মুভার, পণ্য পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ ট্রাক ড্রাইভারস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন দেড় দিনের ধর্মঘট পালন করে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-ট্যাঙ্ক-লরি প্রাইম মুভার ওনার্স ওয়ার্কার্স কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলও একই ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। কিন্তু, দাবি পূরণে সরকারের আশ্বাসের পর তারা এই ঘোষণা থেকে সরে আসে।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments