যে পার্কে পড়তে আসে ছিন্নমূল শিশুরা!

খোলা আকাশের নিচে চলছে ‘ভিন্নদৃষ্টির পাঠশালা’র পাঠদান। ছবি: স্টার

বগুড়ার চেলোপাড়া এলাকায় সকালের মাছবাজারের আঁশটে গন্ধ বিকেলের দিকে খানিকটা থিতিয়ে আসে। পশ্চিমে ঢলে পড়তে থাকা রবির তেজেও পাশের মৃতপ্রায় করতোয়া নদীর পানির দুর্গন্ধ একইরকম থেকে যায়। ঠিক তখনই চেলোপাড়া শিশুপার্কে রেলবস্তির একদল শিশু আসে তাদের 'পাঠশালায়' হাজিরা দিতে।

স্কুল ছুটির পর পার্কটিতে অন্য শিশুদের খেলা চলে। তার মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে 'ভিন্নদৃষ্টির পাঠশালা'য় পড়া চলে ছিন্নমূল শিশুদের।

২০১৮ সাল থেকে বগুড়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু উদ্যোমী শিক্ষার্থী এই পার্কে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা পয়সায় পাঠদানের উদ্যোগ নেন। এখানকার নিন্ম আয়ের মানুষের যে ছেলে-মেয়েরা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায় না, অর্থাভাবে গৃহশিক্ষকের খরচ যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না যাদের পক্ষে, তারাই এখানে পড়তে আসে।

এই পাঠশালায় পাঠ নিতে থাকা তমা (১২) স্থানীয় চেলোপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বাবা সোহেল রানা একজন রিকশাচালক। ৪ ভাই-বোনসহ তমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ জন।

ছবি: স্টার

তমা জানায়, অর্থের অভাবে তার বড় ২ ভাই-বোন পড়াশোনা করতে পারেনি।  কিন্তু স্কুলের পাশাপাশি এই পাঠশালায় পড়ে সে উপকৃত হচ্ছে। সে বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

চেলোপাড়া বস্তির রাজিয়া বেগমের ২ সন্তান। স্বামী বাবু মিয়া ভ্যানে করে আখের রস বিক্রি করেন। রোজগার কম হওয়ার কারণে বাচ্চাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি। দিতে পারেন নি কোন তাই ২ সন্তানকেই তিনি ভিন্নদৃষ্টির পাঠশালায় পড়তে পাঠান।

ভিন্নদৃষ্টির পাঠশালার উদ্যোক্তারা বলছেন, ভিন্ন কোনো মত কিংবা পথের কথা বলতে তারা এই পাঠশালার এমন নামকরণ করেননি। এর অর্থ সমাজে ভিন্নভাবে থাকা সুবিধবঞ্চিত শিশুদের ওপর দৃষ্টি। এখানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেনি পর্যন্ত পড়া শিশুদের পাঠ দেন তারা।

পাঠশালার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রিংকু রায় (২৬) স্থানীয় একটি কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক করেছেন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় তারা ৪ বন্ধু ঈদের সময় নিজেদের চাঁদার টাকায় ছিন্নমূল শিশুদের জামা কিনে দিতেন। পরে সারাবছর ধরে এই ধরনের শিশুদের জন্য কিছু করার জায়গা থেকে তারা এ ধরনের একটি পাঠশালা তৈরির উদ্যোগ নেন।

ছবি: স্টার

রিংকু বলেন, পাঠশালাটি কোথায় বসানো হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা শহরের দুটি এলাকায় একটি জরিপ করি। দেখতে পাই, চেলোপাড়া এলাকার শিশুদের অবস্থা বেশি খারাপ। এদের কারও অভিভাবক ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। কোনো কোনো শিশু ময়লা-আবর্জনার ভেতর থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে। কারও বাবা রিকশা চালান।

রিংকু জানান, বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি এখানে পড়তে আসা শিশুদের তারা সাধ্যমত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করেন, কাপড়-চোপড় দেন, স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত এখান থেকে দেড়'র বেশি শিশু পাঠ নিয়েছে।

ভিন্নদৃষ্টির পাঠশালার কার্যক্রম চলে সপ্তাহে ৩ দিন। মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে পাঠদান। স্বেচ্ছাসেবী ৮ জন শিক্ষক ও তাদের বন্ধুদের টাকায় চলে সবকিছু। এ ছাড়া প্রতিবছর বইমেলায় এই শিক্ষকরা অমর একুশে গ্রন্থমেলায় একটি স্টল দেন। সেখান থেকে আসা মুনাফার অর্থও এখানে যুক্ত করা হয়।

এই পাঠশালার আরেক শিক্ষক মো. সাজু হোসেন বলেন, 'শিশুদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই আমি এই পাঠশালায় যোগ দিয়েছি। এই শিশুদের পড়িয়ে আমি মানসিক প্রশান্তি পাই।'

Comments

The Daily Star  | English
rally demanding ban on awami league in Dhaka

Blockade at Shahbagh demanding AL ban

The demonstration follows a sit-in that began around 10:00pm last night in front of the Chief Adviser's residence

3h ago