রেলওয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই থেকেই দীর্ঘসূত্রতা শুরু

প্রায় আড়াই বছর আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদরকে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করার সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রয়োজনীয় রেলপথ নির্মাণের বিস্তারিত নকশা তৈরি করার একটি প্রকল্প হাতে নেয়।

৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বাজেটের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প গত বছরের অক্টোবরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এর সময়সীমা ২০২১ এর জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সময়সীমা বাড়ানোর পরেও আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র এক চতুর্থাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ফলে কর্তৃপক্ষ আবারো আগামী বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময়সীমা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

শুধু এই প্রকল্পই নয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার বিরুদ্ধে গিয়ে এর আগেও বেশ কিছু সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের সময়সীমা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রেলওয়ে এ ধরণের ৯টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির সময়সীমা একাধিকবার বাড়িয়েছে।

প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, নয়টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র দুইটি পরিকল্পিত সময়সীমা অনুযায়ী আগাচ্ছে। একটি প্রকল্প একবার সংশোধন হয়েছে এবং সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ায় অন্য আরেকটি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামো ও ক্রয় সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা আছে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পে বিলম্ব তারই প্রতিফলন।

তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা পরামর্শক নিয়োগের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং প্রস্তাবিত রেল লাইন কোথায় বসানো হবে, সে সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন করার প্রবণতাকে বিলম্বের জন্য দায়ী করেন। রেলওয়েতে এসব অহরহ ঘটছে এবং এতে প্রচুর সময় নষ্ট হয় এবং প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়।

২৫ কোটি টাকার চেয়ে বেশি সম্ভাব্য ব্যয়ের যেকোনো প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই আবশ্যক। কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, সম্ভাব্যতা যাচাই করতে দেরি হওয়ার কারণে মূল প্রকল্প শুরু হতেও দেরি হয়।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৪১ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ের ৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বেশিরভাগ প্রকল্পের অর্থায়ন হচ্ছে বিদেশি ঋণের মাধ্যমে। ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও ঋণ নেওয়া হয়েছে।

৩৭টি প্রকল্পের মধ্যে ২৬টি কমপক্ষে একবার সংশোধন করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারটি প্রকল্প কমপক্ষে এক দশক আগে হাতে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো এখনো শেষ হয়নি।

প্রখ্যাত পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক জানান, নিরীক্ষা প্রকল্পের জন্য বাড়তি সময় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার পেছনে 'যৌক্তিক কারণ' থাকতে হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুর্বলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর সময়সীমা ও খরচও বেড়ে যায়।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক শামসুল আরও বলেন, 'দুঃখজনকভাবে, সম্ভাব্যতা যাচাই করা সত্ত্বেও বারবার প্রকল্পের সময়সীমা ও খরচ বাড়ছে, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।'

তিনি যোগ করেন, 'যেসব পরামর্শক সম্ভাব্যতা যাচাই করেন, তাদেরকে বিলম্বের জন্য দায়ী করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিলম্ব না হয়।'

৯ প্রকল্প

নয়টি সম্ভাব্যতা প্রকল্পের মধ্যে ছয়টির অর্থায়ন করে সরকার। বাকি তিনটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প এডিবির অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ প্রকল্প। এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ২০১৯ এর জানুয়ারিতে শুরু হলেও এর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বেশ আগে।

২০১২ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হবে। তারপর বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি প্রাথমিক নিরীক্ষা চালায়।

তবে ২০১৯ এর জানুয়ারিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় নিরীক্ষা প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়ার আগে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২০ এর অক্টোবর।

অবশেষে গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ে এই কাজের জন্য একটি চীন-বাংলাদেশ যৌথ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে। তবে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে।

ইতোমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান ও সুনামগঞ্জের অন্য সংসদ সদস্যদের মধ্যে রেলপথ কোথায় বসানো হবে, সে বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। সম্প্রতি, প্রকল্পের সময়সীমা ২০২২ এর জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আরিফ বিলম্বের জন্য রেলপথ বসানোর জন্য এলায়েনমেন্ট নির্ধারণ জটিলতা ও করোনাভাইরাস মহামারিকে দায়ী করেন।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ রেলওয়ে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও মেহেরপুরের মুজিবনগরের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষা শুরু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই রেলপথ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার মধ্য দিয়ে যাবে এবং এর জন্য নির্ধারিত বাজেট ও সময়সীমা যথাক্রমে ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ২০২০ এর আগস্ট।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ যৌথ কোম্পানির সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি করে, কিন্তু এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক আরিফুল ইসলাম জানান, সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে এবং তারা এখন বিস্তারিত নকশা তৈরিতে ব্যস্ত আছেন। তিনি ২ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংশোধিত সময়সীমা অনুযায়ী আমরা এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী।'

তিনি জানান, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কিছু বিলম্ব ঘটেছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়, যার শিরোনাম 'বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিম জোনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সমীক্ষা'। এর আওতায় তিনটি রেলপথ ও একটি রেলসেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই করার পরিকল্পনা করা হয়।

৯ কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রকল্পের সময়সীমা ছিল ২০১৯ এর জুন। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত এর ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, পরিকল্পনা অনুযায়ী দেড় বছরের পরিবর্তে এ প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগছে সাড়ে ৪ বছর।

২০১৮ এর মার্চে আরও একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন বে-টার্মিনালকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বাজেটের প্রকল্পের সময়সীমা ছিল ২০১৯ এর মার্চ। ২০২১ এর আগস্ট পর্যন্ত এর অগ্রগতি মাত্র ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। স্বভাবতই এর সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২২ এর জুন করা হয়েছে।

এডিবির কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়নে 'ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রোজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি' প্রকল্পের বাজেট ধরা হয় ১২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এটি ২০১৫ এর জুলাই থেকে ২০১৯ এর জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

বেশ কয়েকবার সংশোধনের পর এই প্রকল্পের সর্বশেষ সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে ২০২২ এর জুন।

এছাড়াও 'টেকনিকাল অ্যাসিস্টেন্স ফর রোলিং স্টক অপারেশন্‌স ইমপ্রুভমেন্ট অফ বাংলাদেশ রেলওয়ে' প্রকল্পের সময়সীমা এক বছরের জন্য বাড়িয়ে ২০২২ এর জুন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

গোপালগঞ্জের গোবরা থেকে পিরোজপুর ও বাগেরহাট পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প সময়সীমা এ বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়, পরবর্তীতে সেটি বাতিল করা হয়।

আরও ২টি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প সময়সীমা অনুযায়ী আগাচ্ছে। প্রকল্পের নথি ও কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১টি হচ্ছে রাজবাড়ীতে রেলওয়ে কারখানা নির্মাণ প্রকল্প এবং অন্যটি হচ্ছে 'টেকনিকাল অ্যাসিস্টেন্স ফর রেলওয়ে কানেক্টিভিটি ইম্প্রুভমেন্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি।'

প্রকল্প নীতিমালা লঙ্ঘন

উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন ও সংশোধনের কাজ ২০১৬ সালের সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী হয়ে থাকে।

নীতিমালার ৪(১) নং ধারা অনুযায়ী, ২৫ কোটি টাকার বেশি সম্ভাব্য ব্যয়ের যেকোনো বিনিয়োগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই করা আবশ্যক। ৪(৩) নং ধারা অনুযায়ী প্রয়োজন হলে সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষা শুধুমাত্র একবার সংশোধন করা যাবে।

৪(৪) ধারায় বলা হয়েছে, একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের সময়সীমা 'যৌক্তিক কারণে' ছয় মাস বাড়ানো যাবে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী চাইলে সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করতে পারেন, যদি সংশোধনের খরচ প্রকল্পের সার্বিক ব্যয়ের ১৫ শতাংশের চেয়ে কম হয়। যদি সংশোধনের ব্যয় প্রকল্পের ব্যয়ের চেয়ে ১৫ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে পরিকল্পনা মন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

কারিগরি সহায়তার প্রকল্পের ক্ষেত্রে ৭(১) ধারায় বলায় হয়েছে এ ধরনের প্রকল্প দুই বারের বেশি সংশোধন করা যাবে না। তবে বিশেষ প্রয়োজনে তা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে তা সংশোধন করা যাবে।

প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, চারটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের সময়সীমা ছয় মাসের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও দুইটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের সময়সীমা তিন বছর ও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বক্তব্য

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, পরামর্শক নিয়োগের দীর্ঘ প্রক্রিয়াই সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পে বিলম্বের মূল কারণ। কমপক্ষে দুইটি ঘটনায় প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার প্রায় দেড় বছর পরে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়।

কোন পথ দিয়ে প্রস্তাবিত রেললাইন তৈরি করা হবে, সে বিষয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের 'চাপ অথবা তদ্বির' বিলম্বের আরেকটি প্রধান কারণ, জানান কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার জানান, বিলম্বের কারণগুলো প্রকল্প ভেদে পরিবর্তিত হয়। তবে রেললাইন কোন দিক দিয়ে তৈরি করা হবে, সে সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তিত হওয়া এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এই মুহূর্তে বিলম্বের মূল কারণ।

প্রকল্প নীতিমালা লঙ্ঘন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'কীভাবে আমরা পরিপত্রের বিরুদ্ধে যাব? আমার ধারণা আপনি ভুল করছেন।'

তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন থেকে 'বিশেষ অনুমতি' নেন, কারণ কোনো প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই একের অধিক বার সংশোধনের ক্ষেত্রে কী করণীয়, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh energy import from Nepal

Nepal set to export 40mw power to Bangladesh via India today

Bangladesh has agreed to import electricity from Nepal for the next five years

53m ago