সুখরামদের কপালে সুখ নেই

ভালোই ছিলেন সুখরাম। সন্তান-সন্ততি নিয়ে দিন খুব খারাপ কাটছিল না এই চা শ্রমিকের। তবে সম্প্রতি বাগানে এক শ্রমিকের ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর এক ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বৈকুণ্ঠপুর চা-বাগান। এর জের ধরেই বন্ধ হয়ে যায় বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের মজুরি-রেশন। ফলে উপার্জনের পথ না থাকায় সুখরামের মতো বাগানের অন্য শ্রমিকরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
গত ১ মাস ধরে সুখরাম জঙ্গল থেকে ঘাস কেটে তা বাজারে বিক্রি করছেন। ঘাস কাটার সময় লজ্জাবতী লতার কাটায় তার হাতের এখানে-ওখানে ছড়ে গেছে। ওই হাত দিয়ে এখন ঠিকমতো খেতেও পারেন না তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ছড়ে যাওয়া হাত দেখিয়ে কেঁদে ফেলেন সুখরাম। নিজের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে জানান, বাগানের অন্য শ্রমিকদের অবস্থাও এখন অনেকটা তার মতোই।
বৈকুণ্ঠপুর চা-বাগানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নভেম্বর মাসে বাগানের স্থায়ী শ্রমিক দিলীপ কেউট বাগানের ভেতরের কৃষিজমিতে নিজের জন্য বসতঘর নির্মাণের কাজ শুরু করলে তাতে আপত্তি জানায় বাগানের মালিকপক্ষ। এর জের ধরে চলতি মাসের শুরুতে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
এর প্রতিবাদে ৭ ডিসেম্বর বাগান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শ্রমিক নেতারা। ওই বৈঠকে ২ পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এ সময় বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়াকে লাঞ্ছিত করেন শ্রমিকরা। এরপর ৮ ডিসেম্বর থেকে বাগানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ।
পরে ১৪ ডিসেম্বর মোহাম্মদ শামসুল হক বাদী হয়ে ১২ শ্রমিককে আসামি করে মাধবপুর থানায় মামলাও করেন।
বাগানের শ্রমিক মীরা কৈরী বলেন, 'আমরা মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করি। এই টাকায় এমনিতেই সংসার চলে না। তাই আমাদের তেমন কোনো সঞ্চয় নেই। এখন এক মাসের বেশি সময় ধরে বাগান বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।'
যাকে নিয়ে এই ঘটনার সূত্রপাত, সেই দিলীপ কেউট বলেন, 'আমি বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। ১৫/১৬ বছর ধরে এখানে কাজ করি। কিন্তু বাগানে আমার কোনো ঘর নেই। ভাইয়ের ঘরে থাকি। ছোট ঘরে ২টি পরিবার একসঙ্গে থাকা কষ্টকর। তাই বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে খালি জায়গায় একটি ঘর নির্মাণ করছিলাম। কিন্তু ঘরের কাজ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন বাগান কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানায়। পরে আমাকেও বহিষ্কার করে।'
অবশ্য বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শামসুল হকের ভাষ্য, দিলীপ কেউট ঘর নির্মাণের অনুমতি নেননি। তিনি বলেন, 'আলোচনার কথা বলে শ্রমিকরা আমার কক্ষে এসে হামলা চালায়। এতে আমি ও আরেকজন স্টাফ আহত হই। এরপর আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাগানের কার্যক্রম বন্ধ রাখে মালিকপক্ষ।'
শামসুল হকের বক্তব্য, 'আমরা বাগান চালু করতে চাই। তবে শ্রমিকদেরও নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে হবে। তাই তাদের কিছু শর্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা মানছে না। ফলে বাগানও চালু করা যাচ্ছে না।'
এ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম বলেন, 'আমি চা-বাগানটি পরিদর্শন করেছি। আশা করছি ২ পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত একটি সমাধানে আসা যাবে।'
Comments