শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের স্মৃতিচারণ

‘২৬ মার্চ ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বেরোনোয় শহীদুল্লা কায়সার খুব ধমকেছিলেন’

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজশাহী মহিলা কলেজে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ছবি: সৌজন্য

একাত্তরের ২৬ মার্চ ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, ধমক দিয়েছিলেন কেন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই কথা জানান।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সেলিনা হোসেন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জুবাইদা আয়েশা সিদ্দীকা।

সেলিনা হোসেন বলেন, '২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের পরদিন আমি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) ইকবাল হল দেখতে যাই। সবাই অবাক হয়েছিল। আমি আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। ইকবাল হলের ছাত্র-শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করতেন, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম অগণিত লাশ আর রক্ত।'

'হল থেকে ফেরার পথে হলের সামনে দেখলাম একটা জিপ গাড়ি এসে থামল। সেই জিপে ছিলেন লেখক শহীদুল্লা কায়সার। তিনি দুজন বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা শহরের পরিস্থিতি দেখাচ্ছিলেন।'

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বললেন, 'শহীদুল্লা কায়সার আমাকে দেখেই বকাঝকা শুরু করলেন। প্রচণ্ড ধমক দিলেন। বললেন, বাসায় যাও, কেন বেরিয়েছ এই অবস্থায়? এভাবে আমাকে সেদিন তিনি খুব বকেছিলেন আর বলেছিলেন, 'যাও, এখুনি বাসায় যাও। খবরদার, তুমি আর বের হয়ো না।'

'আমি যুদ্ধের নয় মাসে বার বার বাইরে বের হয়েছি। কাউকে ভয় পেতাম না। সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল আমি দেখতে তো ছোটখাটো, এইটুকু, আমি কারো নজরে পড়তাম না।'

সেলিনা হোসেন বলেন, 'একদিন বাংলা একাডেমিতে পাকিস্তানি সেনারা এসে সরদার ফজলুল করিমকে আমাদের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।'

'ভাবলাম তাকে মেরেই ফেলবে কি না! তিনি আমার খুব প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন।'

তিনি বলেন, জেলখানায় থাকার কারণে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন, নইলে তাকেও পাকিস্তানিরা মেরে ফেলত।

'অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে তার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়।' 

'অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত তার ভূমিকার কারণে হত্যা করা হয়েছে,' বলেন সেলিনা হোসেন।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের সময় জেলখানায় বসে 'কবর' নাটকটি লিখেছিলেন। তিনি বলেন, এই কবর নাটক লিখে তিনি একজন অসাধারণ লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করা সবার জন্য একটা বড় কর্তব্য উল্লেখ করে তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন যে মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকটি মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে।

তিনি বলেন, মুনীর চৌধুরী শুধু একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী নন, তিনি বাংলার একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

সেলিনা হোসেন তার ছেলেবেলায় প্রতিষ্ঠিত কলেজ ছেড়ে নতুন স্থাপিত মহিলা কলেজে ভর্তি হবার অভিজ্ঞতার কথাও স্মৃতিচারণ করেন।

'আমি ১৯৬২ সালে রাজশাহী পিএন গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। সে সময়ে শব্দটা ম্যাট্রিক বলা হতো। পরের বছর থেকে এসএসসি নাম প্রবর্তিত হয়। পাশ করার পরে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হই এবং সেখানে ক্লাস শুরু করি।'

'এর মধ্যে ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহীর সুশীল সমাজের কয়েকজনের উদ্যোগে মেয়েদের জন্য একটা আলাদা কলেজ স্থাপিত হয়। তারা শহরের ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রী আমি এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি বাবাকে বোঝালাম, বললাম মন খারাপ করবেন না, শিক্ষার ব্যাপারটা আমার কাছে। আমি যদি লেখাপড়া করি, তাহলেই হবে। আমি এই কলেজে ভর্তি হই।'

১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেলিনা হোসেনকে।

তিনি বলেন, 'কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করল যে অনার্স খোলা হবে, আমিও রাজি হলাম অনার্স পড়তে। এক বছর পড়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিলো যে সেখানে অনার্স অনুমোদন দেওয়া যাবে না। আমি ভেঙে পড়লাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে গিয়ে আবার প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে বলা হলো। পরে তৎকালীন উপাচার্যকে বোঝালাম এবং তিনি আমাকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করে নিলেন।'

সেলিনা হোসেন বলেন, এই কলেজেই লেখক হিসেবে তার হাতেখড়ি হয়।

'১৯৬৪ সালে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার বিভাগের সব কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। আমি কলেজে বিতর্ক, আবৃত্তি, অভিনয়, সমবেত সংগীত, নৃত্য এসব করতাম। কিন্তু আমার এক শিক্ষক আব্দুল হাফিজ আমাকে একটি গল্প লিখতে বলে প্রতিযোগিতায় আমার নাম পাঠিয়ে দিলেন। আমি কোনদিন গল্প লিখিনি, কী করে আমি এখানে গল্প লিখব। অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ আমাকে ধমক দিয়ে বললেন যা লিখতে পারো সেটা লিখেই জমা দাও। তোমাকে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছে, তোমাকে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হতে হবে এমন কিছু নয়, তুমি যা পারো তাই করো। স্যারের বকুনি শুনে ঘরে বসে বসে একটি গল্প লিখলাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সেই গল্পটি প্রথম নির্বাচিত হলো। এইভাবে আমার সাহিত্য জীবনের সূচনা হলো এই কলেজ থেকে। তারপর আমি থেমে থাকিনি।'

'১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেকগুলো গল্প লিখে ফেললাম। আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ বললেন এই গল্পগুলো দিয়ে তুমি একটা বই করে ফেলো। সেদিনও আমি কেঁদেছিলাম। আমার বই কে বের করে দেবে। পরে, আব্বা আম্মা টাকা দিলেন। বইটি উৎস প্রকাশনী থেকে বেরোয় 'নিরন্তর' নামে।'

সেলিনা হোসেন বলেন, আমি ১৯৭০ সালে ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য দরখাস্ত করলাম। বইটি আমার বায়োডাটায় যোগ করলাম।

তিনি বলেন, 'একটি চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। আমি সেদিনই মুনীর চৌধুরীকে প্রথম দেখি। চাকরিটা হয়ে যায়। কিন্তু, আমি চাকরিতে যাইনি কারণ পোস্টিং ছিল সিলেটে।'

তিনি বলেন, 'বাংলা একাডেমির চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. মো. এনামুল হক, ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী সরফুদ্দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি বলে ভর্ৎসনা করে ড. নীলিমা ইব্রাহিম আমার সার্টিফিকেট টেবিলের এপাশ থেকে ওপাশে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে যত প্রশ্ন করা হয়েছে আমি সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পেরেছিলাম। কারণ, ছাত্রাবস্থায় আমার পড়ার অভ্যাস ছিল। বন্ধুরা যখন আড্ডায় বসত, আমি ছুটে যেতাম লাইব্রেরিতে পড়তে। সেজন্যই চাকরির ইন্টারভিউতে আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি এবং বাংলা একাডেমির চাকরিটা আমার হয়েছিল।'

আবারো মুক্তিযুদ্ধের কথায় ফিরে আসেন সেলিনা হোসেন। বলেন, 'আমি সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলোনিতে থাকতাম। সেখানে সিদ্দিকী নামের একজন বিজ্ঞানীও থাকতেন। তাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল লাল-সবুজ রঙের একটি বাস ভর্তি রাজাকারদের দল। তারা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় সিদ্দিকীকে। আমি আমার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়াটা নিজের চোখে দেখেছি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর এমনই ছিল।'

Comments

The Daily Star  | English
sirens sound in israel after iran missile attack

Iran foreign minister to address UN Human Rights Council

Trump to decide within two weeks on possible military involvement

16h ago