শিয়াল নিক্ষেপ: প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার ‘খেলা’

মানুষের ইতিহাসটা যদি অন্য কোনো প্রাণী লিখতো বা অন্য কোনোভাবে প্রকাশ পেত— তাহলে সেই ইতিহাস বর্ণনায় মানুষকে কীভাবে চিহ্নিত করা হতো; সহানুভূতিশীল নাকি নিষ্ঠুর হিসেবে?
শিগগিরই হয়তো উত্তর জানার কোনো সুযোগ নেই। তবে মানুষের বয়ানেই অন্য প্রাণীদের ওপর মানুষের করা নির্মম নির্যাতনের অসংখ্য উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনটা অ্যাডওয়ার্ড ব্রুক-হিচিংয়ের 'ফক্স টসিং অ্যান্ড আদার ডেঞ্জারাস স্পোর্টস' বই থেকে জানা যায় ফক্স টসিং বা শিয়াল নিক্ষেপ নামে প্রাণীদের ওপর মানুষের চালানো এক তীব্র নির্মম আয়োজনের কথা।
১৭ ও ১৮ শতকে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় সভ্যতার সংজ্ঞা নির্মাণে সদা তৎপর ইউরোপের অনেক জায়গায় ঘটা করে আয়োজন করা হতো রক্তাক্ত এক 'খেলার'। যার নাম ফক্স টসিং। বাংলা করলে হয়তো দাঁড়াবে 'শিয়াল নিক্ষেপ'।
রাজপ্রাসাদ, দুর্গের আঙিনায় কিংবা প্রাচীর তুলে মাঠ বানিয়ে সেখানে এই আয়োজন চলতো।

২ জন মানুষ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুগলরা অংশ নিতেন) একে অন্য থেকে ৬ থেকে সাড়ে ৭ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিতেন। সেই ২ ব্যক্তি প্রেলগার্ন নামের এক জাতীয় কাপড়ের গুলতির ২ প্রান্ত ধরে থাকতেন। তারপর খাঁচা বা ফাঁদ থেকে আটকে রাখা শিয়াল ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে প্রেলগার্নের দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হতো। কোনো শিয়াল ওই কাপড়ের গুলতির ওপর ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই দুজন সর্ব শক্তি দিয়ে শিয়ালটিকে উপরে ছুঁড়ে মারতেন।
জোটবদ্ধ 'খেলোয়াড়রা' দাঁড়াতেন নিজেদের মধ্যে খানিকটা দূরত্ব রেখে সারিবদ্ধভাবে। যাতে করে এক দলের ছুঁড়ে মারা শিয়াল অন্য দলের গুলতিতে গিয়ে পড়লে তারা আবারও সেই শিয়ালকে 'খেলার রসদ' হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
কোন দল জিতলো, কোন দল হারলো তা নির্ধারণ করা হতো তাদের ছুঁড়ে মারা শিয়ালের সর্বোচ্চ উচ্চতা অতিক্রমের মধ্য দিয়ে। গড় 'রেকর্ড' উচ্চতার কথা জানা যায় প্রায় ৮ মিটার।
এ 'খেলায়' সাধারণত অভিজাত শ্রেণির লোকেরা অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি জানা যায়, ১৬৭২ সালের মার্চে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত এক শিয়াল নিক্ষেপ আয়োজনে রোমান সম্রাট প্রথম লিওপোল্ডের অংশগ্রহণের কথা।
এই 'খেলায়' শিয়ালের সঙ্গে প্রায়শই অন্য প্রাণীদের ব্যবহার করা হতো এবং 'খেলা' শেষে নির্মম লোফালুফির শিকার হয়ে সেই সব প্রাণীর রক্তাক্ত নিথর দেহ সমগ্র মাঠ, আঙিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো।

ড্রেসডানে অনুষ্ঠিত এক ফক্স টসিংয়ের আয়োজন করেছিলেন পোলান্ডের রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাস। যেবার নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ৬৪৭টি শিয়াল, ৫৩৩টি খরগোশ, ৩৪টি ব্যাজার এবং ২১টি বন বিড়াল হত্যা করা হয়েছিল।
সেই আয়োজনে রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাস নিজেও অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের শারীরিক শক্তি নিয়ে প্রচলিত অবিশ্বাস্য সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে 'খেলতে' নেমে তিনি প্রেলগার্নের মাথা ধরতে ব্যবহার করেছিলেন নিজের শুধুমাত্র একটা আঙুল; আর প্রেলগার্নের অন্য প্রান্তে দাঁড় করিয়েছিলেন তার রাজসভার দুজন কর্মচারীকে।
জানা যায়, ছুঁড়ে মারা প্রাণীদের জীবন বাঁচাতে বা ভীত হয়ে 'খেলায়' অংশগ্রহণকারীদের আক্রমণ বা প্রেলগার্ন আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালানোর কথা। যাতে করে তাদের আর শূন্যে নিক্ষেপ না করা যায়।
এই 'খেলার' আয়োজনকে বিশেষ মাত্রা দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পুরুষেরা মুখোশ ও পোশাক পরে পৌরাণিক বীর, জন্তু ও রোমান যোদ্ধার বেশ ধারণ করতেন। অন্যদিকে নারীরা নিম্ফ ও দেবীর বেশ নিতেন। আর শিয়াল, খরগোশদের 'সাজানোর' জন্য ব্যবহার করা হতো ঝালর দেওয়া কাপড়, টুকরা টাকরা কার্ডবোর্ড ইত্যাদি।
নির্মমতার এই মহাসমারোহ শেষ হলে অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক সবাই মিলে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করতেন কিংবা রাজকীয় ভোজে অংশ নিতেন।
তথ্য সূত্র:
হাওয়ার্ড এল ব্লাকমোর, হান্টিং ওয়েপনস: ফ্রম দ্য মিডল এজেস টু দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি; অ্যাডওয়ার্ড ব্রুক-হিচিং, ফক্স টসিং, অক্টোপাস রেসলিং অ্যান্ড আদার ফরগটেন স্পোর্টস।
Comments