গল্পটা সিনেমার নয়, রেমিট্যান্স যোদ্ধার

সাধারণ একজন মানুষের কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা, পুনরায় দেশে ফেরা, আবার মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা, দালালের সহযোগিতায় ২টি দেশ পেরিয়ে ইউক্রেনে পৌঁছানো, সেখানে যুদ্ধ লাগা, যেকোনো সময় মৃত্যুর আতঙ্কে ২২ দিন কাটানো, অতঃপর ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সে পৌঁছানো।

সাধারণ একজন মানুষের কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা, পুনরায় দেশে ফেরা, আবার মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা, দালালের সহযোগিতায় ২টি দেশ পেরিয়ে ইউক্রেনে পৌঁছানো, সেখানে যুদ্ধ লাগা, যেকোনো সময় মৃত্যুর আতঙ্কে ২২ দিন কাটানো, অতঃপর ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সে পৌঁছানো।

গল্পের প্লটটা কোনো সিনেমার নয়। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের সন্তান উজ্জ্বল আলি মিঁয়ার, একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধার জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা।

গত ১৬ মার্চ যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেনের জুরাভিসের একটি ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। এর আগে প্রায় ৬ মাস তাকে থাকতে হয়েছে এই ক্যাম্পে।

পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগের কারণে জুরাভিসের ক্যাম্প থেকে তিনিসহ ৪ বাংলাদেশি মুক্তি পান।

ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে পোল্যান্ড হয়ে ১৮ মার্চ রাতে ফ্রান্সে পৌঁছেছেন উজ্জ্বল। সেই যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'জুরাভিসের ক্যাম্প থেকে আমাদের ছেড়ে দেওয়ার পর কোনো পরিবহণ পাইনি। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মাইল পথ পায়ে হেঁটে একটি ছোট শহরে পৌঁছাই। শহরটির নাম মনে নেই। বরফের মধ্যে এত দীর্ঘ পথ হেঁটে পায়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। নখও উঠে গেছে।'

'ওই শহরে ট্যাক্সি পাই। আল্লাহ যেন ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলেন। পোল্যান্ড সীমান্তে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিচালক রাজি হন। ২ ঘণ্টা পর পৌঁছাই ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে। ওই সীমান্তটি ছিল বেলারুশের কাছাকাছি। আমরা সীমান্ত পার হতে চাইলে পোল্যান্ড ইমিগ্রেশন আমাদের জানায়, ওই সীমান্ত দিয়ে আমরা ঢুকতে পারব না। এ কারণে সেখান থেকে বের হয়ে অন্য কোনো সীমান্তে যাওয়ার জন্য রওনা দেই।'

বেঁচে থাকার তাগাদা যে কী হতে পারে তা প্রতি মুহূর্তে যেন প্রত্যক্ষ করছিলেন উজ্জ্বল। জীবিকার তাগিদে ভিনদেশে এসে আহত পা আর শ্রান্ত শরীর নিয়ে তার এই যাত্রা কেবলই যেন বেঁচে থাকার।

ইমিগ্রেশন থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে উজ্জ্বল যখন অন্য কোনো সীমান্তে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন, তখন তার সামনে পরে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী।

উজ্জ্বল বলেন, 'গাড়ি থেকে একজন সিনিয়র অফিসার নেমে আসেন। তিনি আমার কাছে যানতে চান, সীমান্ত পার না হয়ে ফিরে এলাম কেন। তখন তাকে ইমিগ্রেশনে কী হয়েছে সেটা বলি।'

'ওই অফিসার অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পোল্যান্ড ইমিগ্রেশনে যান এবং সব কাগজপত্র দেখিয়ে আমাদের পার করে দিতে বলেন। তখন ইমিগ্রেশন থেকে আমাদের সব কাগজ দেখে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে পোল্যান্ডে ঢুকতে দেয়।'

'সীমান্তে আমরা পৌঁছাই সন্ধ্যার দিকে। শেষ পর্যন্ত রাত ১টা বা দেড়টার দিকে পোল্যান্ডে ঢুকতে পারি,' যোগ করেন তিনি।

পোল্যান্ডে ঢোকার পর উজ্জ্বলের প্রাণ যেন আসলো ধরে। এখন অনেকটাই নিরাপদ তিনি। হঠাৎ কোনো গুলি বা বোমার আঘাতে মরতে হবে—এমন ভয় নেই। ওই রাত তার কাটে পোল্যান্ড সীমান্তবর্তী একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।

পরদিন সকালে বাসে ও ট্রেনে তিনি পৌঁছান দেশটির রাজধানী ওয়ারশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে। সেখানে তার খাবারসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। এরপর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ফ্রান্সে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন দূতাবাস কর্মকর্তারা।

ফ্রান্স থেকে হোয়াটসঅ্যাপে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে তার কেটেছে ৮ বছর। এরপর দেশে ফিরে আসেন। দেশে কিছুদিন থেকে আবার যান মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। আমিরাতের দুবাই শহরে কোটি টাকা উড়তে থাকলেও সেখানে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তবে, পরিচয় হয় এক দালালের সঙ্গে।

'ওই দালালের সঙ্গে সাড়ে ৭ লাখ টাকার চুক্তি হয় ইউক্রেন পৌঁছে দেওয়ার জন্য। দেশে যোগাযোগ করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেই। দুবাই থেকে তারা প্রথমে আমাকে নিয়ে যায় উজবেকিস্তান। এরপর সেখান থেকে নিয়ে যায় কিরঘিস্তান। কিরঘিস্তান থেকে আমাকে স্টুডেন্ট ভিসায় ইউক্রেন পাঠানো হয়।'

'আমার সঙ্গে আর ৪ জন বাংলাদেশি ছিলেন। যে সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়েছিলাম, সেখান থেকে আমাদের প্রত্যেককে ২ হাজার ডলার দেওয়া হয়। ইউক্রেনে পৌঁছানোর পর আমাদের সঙ্গে ডলার এবং স্টুডেন্ট ভিসা থাকায় তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই ঢুকতে পারি।'

উজ্জ্বল বলেন, 'ইউক্রেনে পৌঁছানোর পর একজন পাকিস্তানি আমাদের নিতে আসেন। তিনি আমাদের নিয়ে যান একটি হোস্টেলে। সেখানে গিয়ে আমাদের কাছে থাকা-খাওয়া বাবদ তিনি ১০ হাজার ডলার দাবি করেন। অগত্যা তাকে সেই টাকা দিতে হয়।'

সুখের খোঁজে দেশ থেকে দেশান্তরি হতে থাকলেও সুখের নাগাল পাওয়া উজ্জ্বলের জন্য যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। দুবাইয়ে কাজ না পেয়ে সাত সাগর তের নদী পেরিয়ে ইউক্রেনে এসেও কাজের সুযোগ পান না তিনি।

উজ্জ্বল বলেন, 'ইউক্রেনে যে কাজ নেই, এত কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে তা কল্পনাও করিনি।'

এভাবেই চলে যায় ৩ মাস। দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠানো তো দূরে থাক উল্টো দেশ থেকেই টাকা নিয়ে কোনো রকমে কাটতে থাকে তার দিনগুলো।

অবশেষে তিনি পরিকল্পনা করেন ইউরোপে যাওয়ার। ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ নয়। তবে এর সীমানা পেরোতে পারলেই ইউরোপ। তিনি ইউক্রেন-রোমানিয়া সীমান্তে যান এবং সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।

'আমাদের দেখে সন্দেহ করে ইউক্রেনীয় বর্ডার গার্ড। আবার স্বপ্নভঙ্গ,' যোগ করেন তিনি।

সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে ধরা পরেন ইউক্রেনীয় বর্ডার গার্ডের হাতে। এরপর থেকেই অন্যদের সঙ্গে তার ঠাঁই হয় জুরাভিসের ডিটেনশন ক্যাম্পে।

সিনেমার গল্পে সাধারণত শেষটা হয় মধুর। অনেকটা তেমনি হয়েছে উজ্জ্বলের। ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে আটক হওয়া উজ্জ্বল এখন ইউরোপে।

তিনি বলেন, 'আশা-হতাশা, ভয়-আতঙ্ক নিয়েই প্যারিসে এসে নামি। কিছুই চিনি না, জানি না। পরিচিত কেউ নেই, পকেটে নেই ইউরো। পেটে তীব্র ক্ষুধা।'

রাতের প্যারিসে ট্রেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে তিনি বাংলাদেশি কাউকে পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজ করতে থাকেন। ঘণ্টাখানেক পর পেয়ে যান কয়েকজন বাংলাদেশিকে।

'সারাদিনে কিছু খাইনি শুনে একজন ১০ ইউরো দিয়ে বললেন, খেয়ে আসেন। খাওয়ার পরের চিন্তা, রাতে থাকব কোথায়? একজন বাংলাদেশি সঙ্গে করে তাদের থাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন। রাতটা কাটলো। এখন চিন্তা আগামী দিনগুলোর। আশা করছি কাজ পেয়ে যাব। দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে,' একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলেন উজ্জ্বল।

প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপির দেশ ফ্রান্সে তার জীবনটা হয়তো বদলে যাবে। হয়তো সিনেমার মতোই বাকিটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিতে পারবেন আনন্দে। আবার এমনও তো হতে পারে, সিনেমা এখানেই শেষ নয়।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda returns home after 6 days in hospital

Thousands of party activists, along with senior BNP leaders, are escorting Khaleda's convoy back to her Gulshan residence

30m ago