ভেনেজুয়েলা কি রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে?

ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের পর রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবরোধ ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পুতিনের দেশ। আগ্রাসনের ২ সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন জোর আলোচনায় ভেনেজুয়েলা।
দক্ষিণ আমেরিকার তেলসমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলা প্রয়াত সমাজতান্ত্রিক নেতা হুগো চাভেজের দেশ হিসেবেও পরিচিত। তেলের টাকায় সাধারণ মানুষের উপকার করার আশ্বাস দিয়ে তিনি দেশটির জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বে যখন সমাজতন্ত্র 'বিলুপ্তি' পথে, তখন তিনি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভেনেজুয়েলায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের পতনের মাত্র ৮ বছরের মাথায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা চাভেজ বামপন্থি জোটের প্রার্থী হিসেবে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের 'মাথা ব্যথার' কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
প্রতিবেশী কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি চাভেজ বলিভিয়া ও নিকারাগুয়ায় নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক নেতাদের নিয়ে জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। এতে আরও আতঙ্কিত হয়েছিল শীর্ষ পুঁজিবাদী দেশগুলো। ভেনেজুয়েলার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নানাবিধ অবরোধ।
মুহূর্তেই চাভেজ হয়ে ওঠেছিলেন পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী আর বিশ্বের 'মুক্তিকামী' মানুষের নতুন ভরসাস্থল। এ সবই এখন ইতিহাস।
২০১৩ সালে চাভেজের মৃত্যুর পর ভেনেজুয়েলার ক্ষমতায় আসেন নিকোলাস মাদুরো। একজন বাসচালক থেকে শ্রমিক নেতা ও পরবর্তীতে দেশের রাষ্ট্রপতি মাদুরোকে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র জল কম ঘোলা করেনি। মাদুরোর ভেনেজুয়েলাকেও যুক্তরাষ্ট্র রেখেছে অবরোধের বেড়াজালে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর এই মাদুরো এখন হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত 'মিত্র'। কেন না, রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ গতিশীল রাখতে প্রয়োজন ভেনেজুয়েলাকে।
তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলোর সংস্থা ওপেক জানিয়েছে, তেলের পাশাপাশি ভেনেজুয়েলার রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও আকরিক লোহাসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থ।
গত ২৭ ডিসেম্বর কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, গত নভেম্বরে ইরানের সহযোগিতায় ভেনেজুয়েলা প্রতিদিন ৮ লাখ ২৪ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে।
গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাদুরো। সফররত উচ্চ-পর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তিনি এ ইঙ্গিত দেন।
এরপর দিন ভেনেজুয়েলা কারাগার থেকে ২ মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেয়।
গত মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ভেনেজুয়েলার এমন আন্তরিকতার প্রতিদান দিতে বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে।
আপাত দৃষ্টিতে ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই প্রতিদান হবে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশের তেল বিক্রির ওপর চলমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া।
ভেনেজুয়েলা কি 'বিশ্বাসঘাতকতা' করবে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চাপে থাকা ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প নতুন করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ক্রেমলিনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রেসিডেন্ট মাদুরোর দিকে নজর দিচ্ছে হোয়াইট হাউস।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দনবাস অঞ্চলে ২টি প্রজাতন্ত্রকে মস্কো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে কানকাস সেই পথ অনুসরণ করে। পুতিনের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর মাদুরো প্রজাতন্ত্র দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেন। তাই, পুতিন ও মাদুরোকে 'মানিকজোড়' বললে অত্যুক্তি হবে না।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুদের দেশ ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পিডিভিএসএ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আগে প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করতে পারতো।
লন্ডনের ফরেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরাসি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'মাদুরো দেখবেন ওয়াশিংটন তার কাছে আসলে কী চায়। যদি মাদুরোর প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তাহলে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সখ্যতা অটুট রাখবেন।'
হাউস্টনে রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকের ইনস্টিটিউটের ভেনেজুয়েলার জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ ইগর হার্নান্দেজ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'গত বছর রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করতো। ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে তারা এই পরিমাণ তেল ভেনেজুয়েলা থেকেই নিত।'
তার মতে, 'যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে ভেনেজুয়েলার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাই যদি ভেনেজুয়েলার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় তাহলে দৃশ্যপট ২০১৯ সালের আগের মতোই হবে।'
বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতোমধ্যে ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প বেশ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তবে মার্কিন সহায়তা পেলে তা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
কারাকাসের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক 'ঘনিষ্ঠতা' নিয়ে কঠোর সমালোচনায় পড়েছে বাইডেন প্রশাসন। ফ্লোরিডা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর ম্যারকো রুবিও গত মঙ্গলবার টুইটে বলেছেন, 'ভেনেজুয়েলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের বিনিময়ে হোয়াইট হাউস সেখান থেকে তেল কেনার প্রস্তাব দিচ্ছে।'
মাদুরোকে 'ক্যানসার' হিসেবে উল্লেখ করে ডেমোক্রেট সিনেটর ও সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনেনদেজ এক বার্তায় বলেছেন, 'এই অত্যাচারী ও খুনির শাসনামলে আমরা স্বস্তির শ্বাস নিতে পারব না।'
কাউন্সিল অব দ্য আমেরিকাস'র ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রিয়ান উইন্টার বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, 'পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূলনীতিতে পরিবর্তন আসছে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেন সুনির্দিষ্ট করে বিষয়টি জানাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন।'
এখনো পর্যন্ত মার্কিন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, 'এটা উৎসাহব্যঞ্জক ইঙ্গিত যে, মাদুরো মেক্সিকোয় তার বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার পথে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।'
তবে এর প্রতিদান হিসেবে বাইডেন প্রশাসন কী দেওয়ার কথা ভাবছে, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এখন দেখার বিষয় মাদুরো তার ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিনের সঙ্গে 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেন কি না।
Comments