রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধায় কার লাভ কার ক্ষতি

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে লিভিভ স্টেশনে যুক্তরাজ্যের ৪ জন যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধে বিদেশি ও ভাড়াটেদের যোগ দেওয়ার ইতিহাস সুপ্রাচীন। সেই 'ঐতিহ্য' আজও সমানতালে চলেছে। আফগানিস্তান থেকে লিবিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে ভাড়াটে যোদ্ধাদের দেখা গেছে। তবে এর সুফল দেখা যায়নি কোথাও।

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে ২ পক্ষেই বিদেশি ও ভাড়াটেদের অংশগ্রহণ-প্রসঙ্গ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয়।

ইউক্রেনের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাজারো স্বেচ্ছাসেবক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিদেশি ও ভাড়াটেদের নিয়ে 'আন্তর্জাতিক সেনাদল' গঠন করা হয়েছে।

গতকাল আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, কিয়েভ জানিয়েছে এখন পর্যন্ত ৫২ দেশ থেকে ২০ হাজারের মতো মানুষ ইউক্রেনের 'আন্তর্জাতিক সেনাদলে' যোগ দেওয়ার আবেদন করেছেন।

ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিতে এস্তোনিয়ার ৩ জন পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করছেন। ছবি: রয়টার্স

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের গবেষক আসিয়া মেতোদিভা সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, 'সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসয়ে যোগ দেওয়ার সঙ্গে ইউক্রেন সংকটে বিদেশি যোদ্ধাদের অংশগ্রহণকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।'

এই ভাবনা থেকেই হয়তো পশ্চিমের দেশগুলোর নেতারা অনেকে তাদের নাগরিকদের ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে প্রথমে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে এ নিয়ে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা হতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেকে উল্টো পথ ধরেন।

স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে পশ্চিমের বক্তব্য

রয়টার্সের প্রতিবেদন মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে—অন্য দেশের সেনাবাহিনীতে মার্কিন নাগরিকদের কাজ করতে বাধা নেই।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রুস প্রথম দিকে ইউক্রেনে যুদ্ধে যেতে নিজ দেশের নাগরিকদের উৎসাহ দিলেও পরে তিনি এ বিষয়ে নাগরিকদের সতর্ক করেন।

গত মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ বিষয়ে আইনি বৈধতার বিষয়টি 'অনিশ্চিত'। পরে তিনি তার দেশের নাগরিকদের ইউক্রেনে যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার অনুরোধ করেন।

জার্মানি বলেছে তার দেশের কোনো নাগরিক স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশ নিলে বিচারের মুখে পড়বে না। ডেনমার্ক ও লাটভিয়া জানিয়েছেন, তাদের নাগরিকরাও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে যেতে পারবেন।

কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অনিতা আনন্দ মনে করেন, তার দেশ থেকে কেউ স্বেচ্ছাসেবক হলে সেটাকে 'ব্যক্তিগত বিষয়' হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।

রাশিয়ার অবস্থান

আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেমলিনের বক্তব্য না পাওয়া গেলেও গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পরদিন রাশিয়া টুডে জানিয়েছিল, চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ বলেছেন—প্রায় ১২ হাজার চেচেন স্বেচ্ছাসেবক মস্কোর হয়ে যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে যেতে প্রস্তুত।

গত ৮ মার্চ পেন্টাগনের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য সিরিয়া থেকে লোক জোগাড় করছে রাশিয়া।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পেন্টাগনের দাবি—সিরিয়া ও অন্যান্য দেশের যোদ্ধাদের ইউক্রেনে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুতিন প্রশাসন।

২০১৫ সালে সিরিয়ার যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে যোগ দেয় মস্কো। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একদা সমৃদ্ধ এ দেশটিতে বহুমুখী যুদ্ধ চলছে।

রমজান কাদিরভ। ছবি: রয়টার্স

বিবদমান ২ পক্ষের হয়ে বিদেশি ও ভাড়াটে যোদ্ধারা ইতোমধ্যে ইউক্রেনে লড়াই করছেন উল্লেখ করে মস্কো টাইমস আরও জানায়, চেচনিয়ার এক সময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠজন রমজান কাদিরভ ভিডিও বার্তায় চেচেন যোদ্ধাদের ইউক্রেনে লড়াই ও তাদের কারো কারো নিহতের সংবাদ দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য মিডিয়া লাইন বলেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম চেচেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া আহমাদ জাকায়েভের দাবি, চেচেনরা ইউক্রেনের পক্ষেও লড়াই করছেন।

ভাড়াটে যোদ্ধাদের প্রভাব

যুদ্ধক্ষেত্রে বিদেশি ও ভাড়াটে যোদ্ধাদের ব্যবহার নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের নেওয়া হলে দেশটিতে উগ্র ডানপন্থী মতবাদ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টেফান ওলফ মনে করেন, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর বীতশ্রদ্ধ ব্যক্তিরা সেখানে যোগ দিলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি আরও ভয়াবহ পরিণতির ঝুঁকি আছে।

অধ্যাপক ওলফের এই আশঙ্কার সূত্র ধরে বলা যায়, যুদ্ধ ক্ষণস্থায়ী বা প্রলম্বিত যাই হোক না কেন এ বেড়াজাল থেকে ইউক্রেন সহসা মুক্তি পাচ্ছে না।

রুশ আগ্রাসন থেকে ইউক্রেন কোনোদিন মুক্ত হলেও দেশটিতে পরে গোষ্ঠী বা আদর্শগত দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় বিদেশি ও ভাড়াটেদের অংশ নেওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয়।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বোঝা যায়, রাশিয়ার সামরিক শক্তির সঙ্গে ইউক্রেনের তুলনা চলে না। গত তিন সপ্তাহে রুশ হামলায় ইউক্রেনের ইউরোপীয় কায়দায় সাজানো শহরগুলো এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে শুরু করেছে।

এখন বিদেশি 'স্বেচ্ছাসেবকদের' হাত ধরে ইউক্রেন আরও গভীর অস্থিরতার গহ্বরে ঢুকে যায় কিনা তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।

Comments

The Daily Star  | English

Torch procession at DU demanding justice for JCD leader Shammo

The procession, under the banner of "Students Against Terrorism", began around 8:20pm

9m ago