রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: চাপে চীন-ভারত

জো বাইডেন, নরেন্দ্র মোদী, শি জিং পিং এবং ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' অবস্থায় পড়েছে চীন ও ভারত। নিজেদের মধ্যে বৈরিতা থাকলেও রাশিয়া তাদের দুজনেরই ঘনিষ্ঠ মিত্র। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এতে 'উভয় সংকটে' পড়ে এশিয়ার বৃহৎ দেশ দুটি।

রাশিয়ার সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্ক কেমন তা দেশ দুটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যেই বোঝা যায়। ভ্লাদিমির পুতিনকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্বোধন করেছেন, 'ডিয়ার ফ্রেন্ড' বলে। আরও এগিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, 'বেস্ট অ্যান্ড বোজম ফ্রেন্ড'।

তবে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব তোলা হলে তার পক্ষে বা বিপক্ষে হাত তুলতে পারেনি 'বন্ধু' চীন ও ভারত। এমনকি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে যে প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে তোলা হয়েছিল সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ৫ দেশের তালিকাতেও নেই চীন ও ভারত। উভয় পরিষদেই দেশ দুটি ভোটদানে বিরত ছিল।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সমালোচনা না করে তাহলে ধরে নেওয়া হবে তিনি পুতিনের পক্ষে আছেন। ফলে, চলমান পরিস্থিতিতে চীন ও ভারতের ওপর বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ। হয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, নয়ত পড়তে হবে যুক্তরাষ্ট্রের 'নিষেধাজ্ঞার' ঝুঁকিতে।

গতকাল সোমবার সিএনএন জানায়, পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে চীন ও ভারতের 'দুর্বল' সম্পর্কের কারণে মস্কো নিকট প্রতিবেশী দেশ দুটির সঙ্গে অস্ত্র ও বাণিজ্য সহযোগিতা 'ইস্পাত কঠিন' করে গড়ে তুলেছে।

ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদী এবং শি জিং পিং। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার সঙ্গে চীন-ভারতের সম্পর্ক

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীংলার বরাত দিয়ে গত ৭ ডিসেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি জানিয়েছিল, প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে আগামী ১০ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০৩১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে।

এ ছাড়াও, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে রাজি হয়েছে 'চিরবন্ধু' রাশিয়া ও ভারত।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই'র বরাত দিয়ে জার্মানির ডয়েচে ভেলে গতকাল জানিয়েছে, ইউক্রেন সংকটের পরও চীন ও রাশিয়া কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখবে। এই সম্পর্কে 'তৃতীয় পক্ষকে নাক না গলানো'র বিষয়েও সতর্ক করেছেন তিনি।

চীনের কাস্টমস প্রশাসনের বরাত দিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছিল, ২০২১ সালে রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য রেকর্ড ১৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। বর্তমানে চীন রাশিয়ার শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার।

এমন বিপুল বাণিজ্য রয়েছে যে দেশের সঙ্গে সেই দেশকে যখন আন্তর্জাতিক অর্থ ও বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পশ্চিমা দেশগুলো একাট্টা হয়েছে তখন তা চীন ও ভারতের জন্য অশনি সংকেত বটে।

বাড়তি চাপে ভারত?

জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউসে আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে চীন। বেশ কয়েক বছর ধরে আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে মহাপ্রাচীরের দেশটি। এখন প্রশ্ন—ভারতও কি তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে?

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কাছে অনেক প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রের। 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' নীতিতে ভর করে বৈরী চীনকে চাপে রাখতে ভারতের সঙ্গে বারাক ওবামার সময়কাল থেকে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে চলছে ওয়াশিংটন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারতকে ৪ দেশের নিরাপত্তা জোট 'কোয়াড'-এ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এই সংস্থাটিকে দিনে দিনে আরও কার্যকর করা হচ্ছে।

নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কূটনীতি ও নিরস্ত্রীকরণ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব সিএনএনকে বলেন, 'ইউক্রেনকে নিয়ে ভারত যত না চিন্তিত তারচেয়ে বেশি চিন্তিত তার নিজের ঘাড়ে আচমকা কোনো বিপদ এসে পড়ে কি না তা নিয়ে।'

তার মতে, 'আসলে ভারত সরকার রাশিয়াকে ঢালাওভাবে সমর্থন দিচ্ছে না। সরকারকে আরও সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।'

লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্ত মনে করেন, 'রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দেনদরবারভিত্তিক। ভারত এর মধ্যে ভারসাম্য করতে পারে।'

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস গত ৬ মার্চ জানিয়েছে, ব্রিটেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডোমিনিক রাব ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে চীন ও ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, এ কাজে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের পাশাপাশি ভারতের এগিয়ে আসা উচিত।

গত ৪ মার্চ ভয়েস অব আমেরিকা জানিয়েছে, কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বন্ধু ভারত ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরও পশ্চিমের দেশগুলো পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আন্তর্জাতিক চাপ সামলে নিচ্ছে।

তাদের মতে, ভারত চায় না নিজের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে ইউরোপের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে। এখনো ভারত প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানকেই তার প্রধান শত্রু মনে করে। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমের দেশগুলোর আহ্বানে ভারত সাড়া দিলে সেই সুযোগে চীন ও পাকিস্তান ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। যা ভারতের জন্য 'আত্মঘাতী' হবে।

নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিসটিংগুইশড ফেলো মনোজ জোশি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, 'ভারত চায় না চীন-পাকিস্তান-রাশিয়া জোট গড়ে উঠুক। তাই যখনই রাশিয়ার প্রসঙ্গ আসে তখন ভারত অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।'

তবে সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) ডোনাল্ড লু সিনেটে বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটিকে বলেছেন, 'চলমান বিষয়ে ভারতকে স্পষ্ট অবস্থানে নিতে আমরা সবাই কাজ করছি।'

এখন দেখার বিষয়—নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ-প্রত্যাশী ভারত এই চাপ সামাল দেয় কীভাবে।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

2h ago