পুতিনের চাওয়া কী, পূরণ হবে কোন পথে?

যুদ্ধ হবে কি হবে না– এ নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ উত্তেজনা চলার পর শেষমেষ ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দেওয়া বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, তিনি নিরূপায় হয়ে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন। কারণ, আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
ঘোড়ায় চড়ে সাইবেরিয়ার উবসুনুর হোলো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ভ্রমণরত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রয়টার্স ফাইল ফটো

যুদ্ধ হবে কি হবে না– এ নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ উত্তেজনা চলার পর শেষমেষ ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দেওয়া বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, তিনি নিরূপায় হয়ে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন। কারণ, আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

এখন পরের প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন নিশ্চিত হবেন যে তিনি যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন? তিনি বারবার বলছেন, ইউক্রেন দখলের বা তাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। শুধুমাত্র সামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামোই হবে রুশ বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু।

এমন পরিস্থিতিতে, সবার মনে প্রশ্ন, রাশিয়া ও পুতিনের 'শেষ খেলা' কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথোলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জার্মান মার্শাল ফাণ্ডের ভিজিটিং ফেলো মাইকেল কিমেজ মার্কিন-রুশ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি তিনি ইউক্রেন সংকটের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ইউক্রেন সংকটের চূড়ান্ত পরিণতি কি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে কিমেজ জানান, রাশিয়ার জন্য মূলত ৩টি পথ খোলা আছে। এর ১টি হচ্ছে সরাসরি হামলা।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কিমেজ বলেন, ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী এলাকা ও বেলারুশে রুশ সৈন্য মোতায়েনের আয়োজন থেকেই এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। মার্কিন প্রশাসন ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারবার সতর্ক করছিলেন যে, যেকোনো মুহূর্তে ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে রাশিয়া। সেসময় অনেকেই সরাসরি আক্রমণকে অতিরঞ্জন মনে করলেও গতকাল বাইডেনের পূর্বাভাষ সত্য হয়েছে।

ঠিক যেভাবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছিলেন সেভাবেই আকাশ ও স্থলপথে রুশ বাহিনী অগ্রসর হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের উড়োজাহাজ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও বিমানবাহিনীকে ধ্বংসের দাবি করেছে রাশিয়া।

এ ছাড়া ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চলকে সুরক্ষিত করে পূর্ব ইউক্রেনের একটি বড় অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং কৃষ্ণ সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ইউক্রেনকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে তাদের অর্থনীতিকে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য করাও রাশিয়ার লক্ষ্য হতে পারে বলে জানান কিমেজ।

এ ব্যাপারে তার বক্তব্য, আগামী কয়েক বছরের ব্যবধানে এসব দখলকৃত অঞ্চল রাশিয়ার অংশ হয়ে যেতে পারে। অথবা অঞ্চলগুলো রাশিয়ার মদদপুষ্ট প্রদেশ বা স্বাধীন দেশ হিসেবে কার্যক্রম চালাতে পারে।

এগুলো বাদে ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তনও রাশিয়ার লক্ষ্য হতে পারে বলে জানান কিমেজ। এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ হলো, বর্তমান সরকারের পরিবর্তে রুশ-সমর্থক একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারেন পুতিন। অথবা রাজনৈতিক সরকার উৎখাত করে সামরিক শাসন চালু করে ইউক্রেনকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবেও প্রমাণ করতে পারেন তিনি।

কিমেজের মতে, এ ধরনের কোনো পরিণতি রাশিয়ার জন্যেও খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না। কারণ, ইউক্রেন রাশিয়ার নিকটবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের দেশের সরকার পরিবর্তনের প্রভাব রাশিয়ার ওপরও পড়বে। তবে এতে সার্বিকভাবে যেকোনো পশ্চিমা সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে ইউক্রেনের সমন্বিত হওয়ার প্রচেষ্টায় বাধা দিতে পারবে রাশিয়া।

কিমেজের আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউক্রেন সরকার রাশিয়ার সব দাবি মেনে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানায়, ততক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাশিয়ার মূল চাওয়া হবে, ইউক্রেনকে নিজেদের 'নিরপেক্ষ' রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া এবং ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের সামরিক সংশ্লিষ্টতা ত্যাগের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া।

কিমেজ আরও বলেন, ধারণা করা যায়, এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর সদস্যপদ নেওয়া থেকে ইউক্রেনকে প্রতিহত করাই হবে রাশিয়ার স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কিমেজ অভিমত দিয়েছিলেন, রাশিয়া সরাসরি আক্রমণ না করে বা আক্রমণের পাশাপাশি সাইবার আক্রমণও চালাতে পারে। এছাড়া আক্রমণ বন্ধ করলেও, সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন রেখে ইউক্রেনের অর্থনীতির ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে পারে দেশটি। সেইসঙ্গে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার মতো পূর্ব ইউক্রেনের আরও কিছু অঞ্চলের দখল নেওয়া বা তাদের ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিতে পারে ক্রেমলিন।

কিমেজের ভাষ্য, আক্রমণের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা ও তার সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপের শিকার ইউক্রেনের জনগোষ্ঠী আরও ভীত হয়ে সব দাবি মেনে নেবে, এমনটাই চাইবেন রুশ প্রেসিডেন্ট।

কিমেজের ধারণা, সাময়িকভাবে আক্রমণ বন্ধ করলেও ইউক্রেনকে সার্বক্ষণিক চাপে রাখবেন পুতিন।  এ বিষয়ে তিনি বলেন, বস্তুত, রাশিয়া গত ২ মাসে যা করেছে, সেটি তারা অব্যাহত রাখতে পারে। টানা ২ দিন আক্রমণের পর সহসা আক্রমণ থামিয়ে 'দাবি না মানলে' আরও বড় আকারের হামলার হুমকি দিতে পারেন পুতিন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কিমেজ বলেন, রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা এমনই যে, তারা চাইলেই দিনের পর দিন ইউক্রেনকে চাপে রাখতে পারে। ওয়াশিংটনসহ ইউরোপের রাজধানীগুলোকে বলতে পারে, আরও বড় আকারের আগ্রাসন চালানোও তাদের পক্ষে সম্ভব।

কিমেজের বক্তব্য, 'নিশ্চিতভাবেই ২ দিনের বাধাহীন হামলার পর আলোচনার টেবিলে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে রাশিয়া। এতদিন অনেক বিশ্লেষক বলে এসেছেন, "মুখে বড় বড় কথা বললেও পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ করার ইচ্ছে, সাহস বা সক্ষমতা নেই"। কিন্তু তিনি ২ দিন ধরে আক্রমণ অব্যাহত রেখে তাদের মুখ বন্ধ করেছেন'।

বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

রাশিয়ার অভিযানে সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো দেশ বা কোনো সংগঠন তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

ইতোমধ্যে ন্যাটোর সচিব জানিয়েছেন, ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর কোন পরিকল্পনা নেই তাদের।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২ মাসে ইউক্রেন প্রসঙ্গ নিয়ে যত বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে দেশটির আভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু তিনিও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেবেন, তেমন কোনো ইঙ্গিতও দেননি। তিনি 'ইউক্রেনের জনগণের জন্য প্রার্থনা করবেন' বলে দায় সেরেছেন।

ইউরোপের বাকি পরাশক্তিরাও এখন নীরব। ইউক্রেন যাদের বন্ধু ভেবে ১৯৯৪ সালে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, সেসব রাষ্ট্র এ সংকটে 'সরাসরি' দেশটির পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বিধিনিষেধ আরোপ ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো মিত্র রাষ্ট্র কোনো ধরনের সহায়তার কথা বলছে না।

সার্বিকভাবে পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি পুতিনের নিয়ন্ত্রণে আছে বলা যায়।

এক্ষেত্রে পুতিনের শেষ খেলা কী হবে, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

5h ago