যুক্তরাষ্ট্র চায় রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করুক?

বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে ইউক্রেন সংকট এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ। এই পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরের শিরোনাম—
ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে ইউক্রেন সংকট এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ। এই পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরের শিরোনাম—

 ইউক্রেনে হামলার 'অজুহাত' তৈরি করতে পারে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা

ইউক্রেনে যে কোনো আগ্রাসনের কঠিন জবাব দেওয়া হবে: বাইডেন

এক ডজনেরও বেশি দেশের নাগরিকদের ইউক্রেন ছাড়ার আহ্বান

ইউক্রেনে যে কোনো দিন রাশিয়ার হামলা শুরু হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা

মার্কিন নাগরিকদের ইউক্রেন ছাড়তে বললেন বাইডেন

আগামী মাসে ইউক্রেন 'আক্রমণ' করতে পারে রাশিয়া: বাইডেন

শিরোনামগুলোতে একটি সুর খুবই প্রকট এবং তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের 'সতর্ক বাণী'। হঠাৎ মনে হবে যেন মার্কিনরা চায় রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করুক। তাহলে সেখানে 'নাক গলানোর' সুযোগ পাওয়া যাবে।

জানুয়ারি মাস থেকেই বারবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন জোর গলায় বলছেন 'রাশিয়া শিগগির আক্রমণ করবে'।

পশ্চিমা গণমাধ্যম এ বিষয়ে মোটামুটি একই সুরেই কথা বলে যাচ্ছে। রাশিয়াকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাশক্তির মতো 'গণশত্রু' ও সিনেমার খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরার মার্কিন প্রচেষ্টাকে তারা অযৌক্তিক ভাবছেন না বরং এর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার সকালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ভিডিওতে দেখা গেছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও ক্ষেপনাস্ত্র বহনকারী বাহন ইউক্রেনের দিকে আগাচ্ছে।

তবে রাশিয়ার জনগণের চিন্তাধারা পুরোপুরি ভিন্ন। তারা সবাই মোটামুটি নিশ্চিত, সব দোষ আমেরিকার।

'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) মিলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংকটকে ঘনীভূত করছে', এ ধারণার পক্ষে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে রাশিয়ার বেশিরভাগ গণমাধ্যম। অনেকে একে প্রোপাগান্ডা বলতেও রাজি।

তবে রুশদের মতো বাকি বিশ্বেও অনেকে ভাবছেন, আসলেই কি এটি প্রোপাগান্ডা, নাকি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধলে এ থেকে উপকৃত হতে পারে অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ?

ইউক্রেন সংকট নিয়ে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকরা। কথোপকথনে উঠে এসেছে সারা পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরের কিছু কথা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বেশিরভাগ রুশ নাগরিক সংকটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছেন আর বাকিরা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই রাজি নন।

অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবী ওলগা পেত্রোভা জানান, আমেরিকা এই যুদ্ধের শুরু দেখার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে। ন্যাটো আমাদের সীমানায় সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসার অজুহাত খুঁজছিল। তারা আমাদের দুর্বলতার জায়গাগুলো খুঁজেছে এবং অবশেষে ইউক্রেনকে চিহ্নিত করেছে।

'খুব সম্ভবত বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক জানেই না মানচিত্রে ইউক্রেনের অবস্থান কোথায়', যোগ করেন পেত্রোভা।

রুশদের আলোচনার আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্য পায়, যেমন করোনাভাইরাস মহামারি ও বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ। অন্য কিছু নিয়ে তারা খুব বেশি চিন্তিত নয়।

ইউক্রেনের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে তারা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনের সঙ্গে একমত, 'যুদ্ধ যদি আসে, তবে তা মার্কিনদের কারণেই আসবে।'

লেভাদা সেন্টার নামের রাশিয়ান বেসরকারি ও স্বতন্ত্র জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, ৫০ শতাংশ রুশ নাগরিক এ অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে দায়ী করছে। ৫ শতাংশেরও কম মানুষ ক্রেমলিনকে দায়ী করেছে।

পেত্রোভার সঙ্গী তামারা ইভানোভা জানান, তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন ইউক্রেন ও পশ্চিমের মানুষদের 'ব্রেনওয়াশ' করা হয়েছে।

দুজনই অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী রুশ নাগরিক। তারা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত পেনশন পান এবং এ জনগোষ্ঠী পুতিনের অন্যতম প্রধান সমর্থক হিসেবে বিবেচিত।

গত কয়েক বছরে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও নগরভিত্তিক মানুষ এরকম সশস্ত্র উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীন গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও প্রতিবাদী কণ্ঠের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে পুতিন সরকার। অসংখ্য তরুণ আন্দোলনকারীদের আটক করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

জনমত যাচাইকারী ও সমাজবিজ্ঞানী সের্গেই বেলানোভস্কি জানান, এসব কারণেই অসংখ্য রুশ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণরা এখন আর সংবাদ পড়েন না বা এসব বিষয় নিয়ে গা করেন না।

মেডিকেল ছাত্রী যানা ইয়াকুশকিনা (২০) স্বীকার করেন, তিনি রাজনীতির প্রতি খুব একটা মনোযোগ দেন না।

'যুদ্ধ নিয়ে সব কথাই ফাঁকা বুলি। এ সংঘর্ষ কখনোই শেষ হবে না এবং কেউ এর ব্যাখ্যাও দিতে পারবেন না', যোগ করেন যানা।

ব্যবহারিক গণিতের ছাত্রী ডারিয়া রোকিশেভা (১৯) জানান, তিনিও রাজনীতির ব্যাপারে খুব একটা খোঁজ রাখেন না এবং তিনি বিশ্বাস করেন এ ধরনের সংঘর্ষ দেখা দেয় 'দুই সরকারের মধ্যে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে না।'

বেলানোভস্কি আরও জানান, রুশ নাগরিকরা তাদের ধ্যানধারণায় সম্ভাব্য যুদ্ধের বিষয়টিকে স্থান দিতে নারাজ। তারা বুঝতে পারছেন না কি ঘটছে বা ঘটতে পারে।

'তারা এ বিষয়ের গভীরে যেতে রাজি নন এবং তারা মনে করেন এতে কোনো ফায়দা হবে না', যোগ করেন তিনি।

বেলানোভস্কি জনমতের সূত্র ধরে জানান, অনেক মানুষ পুতিনের আভ্যন্তরীণ নীতির এক বা একাধিক বিষয় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও তারা ইউক্রেন বা পশ্চিমের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক নিয়ে পুতিনের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত। তাদের মতে রাশিয়া হচ্ছে 'বাইরের শত্রুর আক্রমণের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী।'

তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা অ্যালেক্সেই ইজোটভ (৪৫) জানান, তিনি রাশিয়ার নিয়মতান্ত্রিক দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন এবং পুতিনের গায়ের জোরে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতাকেও অপছন্দ করেন, কিন্তু পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে রাষ্ট্রপতি 'যা করছেন, ঠিকই করছেন।'

আমি এটা (পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি) পছন্দ করি এবং আমার ধারণা দেশের বেশিরভাগ মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন।'

তিনি জানান, তিনি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম অনুসরণ করেন না। তিনি ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তা সত্ত্বেও তিনি জানান, বর্তমান ইউক্রেন সংকট পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর উসকানিমূলক আচরণের কারণেই তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চাইছে।'

২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা গেছে। সে সময় রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনে ঢুকে ক্রিমিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়। ২০১৫ সালে একটি অস্ত্রবিরতী চুক্তি সই হয়, তবে সে অঞ্চলে কখনোই বেশি দিন শান্তি বিরাজ করে না।

গত অক্টোবরে ইউক্রেন একটি অস্ত্রসজ্জিত ড্রোনের মাধ্যমে রাশিয়ার মদদপুষ্ট বিদ্রোহীদের পরিচালিত একটি হাউইটজার কামানের ওপর হামলা চালায়।

এ ঘটনাকে অস্ত্রবিরতী চুক্তির লঙ্ঘন দাবি করে রাশিয়া। তারপর থেকেই মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে চলছে যুদ্ধ এড়ানোর (বা শুরু করার!) কূটনৈতিক কার্যক্রম।

পুতিন বরাবরই দাবি করে এসেছেন, ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলে শক্তিমত্তা বাড়ানোর বিষয়টি রাশিয়ার জন্য অস্তিত্ব রক্ষার সংকটের সমতুল্য। তিনি ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ সেনা মোতায়েনের পেছনে কারণ হিসেবে ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের বাড়তে থাকা সুসম্পর্ককে দায়ী করেন।

উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করলেও বাইডেন প্রশাসন মূলত শাসানি ও হুশিয়ারি জারি করার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ হলে কী তাতে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা হবে, না মার্কিনরা ইউরোপে তাদের আধিপত্য বাড়ানোর সুযোগ পাবে? এটা কি ভূরাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের জন্য মার্কিনদের কোনো চাল? না আসলেই রাশিয়ানরা সিনেমার খলনায়কের মতোই আচরণ করছেন?

হয়তো খুব শিগগির জানা যাবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর।

 

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

5h ago