মুক্তিযুদ্ধ

বুরুঙ্গা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ

সিলেটের বালাগঞ্জ থানার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের শান্ত ও নিভৃত গ্রাম বুরুঙ্গা। বুরুঙ্গা ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িবরাক নদী।  
মুক্তিযুদ্ধ
বুরুঙ্গা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

সিলেটের বালাগঞ্জ থানার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের শান্ত ও নিভৃত গ্রাম বুরুঙ্গা। বুরুঙ্গা ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িবরাক নদী।  

মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। হঠাৎ পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে। আতঙ্কিত বুরুঙ্গা ইউনিয়নের গ্রামবাসী দেখা করল বুরুঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইনজাদ আলীর সঙ্গে।

এরপর চেয়ারম্যান ইনজাদ আলী ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছয়েফ উদ্দিন মাস্টারের নির্দেশে ২৫ মে বিকেলে বুরুঙ্গা ও পাশের গ্রামগুলোতে ঘোষণা করা হয়, পরদিন অর্থাৎ ২৬ মে বুরুঙ্গা হাইস্কুলে শান্তি কমিটি গঠন করা হবে। ওইদিনই গ্রামবাসীদের মধ্যে শান্তি কমিটির পরিচয়পত্র বিতরণ করা হবে।

সবাইকে আশ্বস্ত করে বলা হয়, শান্তি কমিটির পরিচয়পত্র থাকলে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো নিপীড়ন বা নির্যাতন চালাবে না। নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে গ্রামের সাধারণ মানুষ। গ্রামের চেয়ারম্যান ইনজাদ আলীর আশ্বাসের পরও গ্রামবাসীর মধ্যে চাপা আতঙ্ক ও ভয় কাজ করছিল। কিন্তু রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের আশ্বাসে ভরসা করে ২৬ মে সকালে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের শান্তি কমিটির সভায় উপস্থিত হয় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের সাধারণ মানুষ।

২৬ মে সকাল ৮টার আগেই এক হাজারের বেশি মানুষ  জড়ো হয় বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সকাল ৮টার দিকে শান্তি কমিটিতে যোগদানের জন্য গ্রামবাসীর তালিকা করা শুরু হয়। সকাল ৯টার দিকে করনসী গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আহাদ চৌধুরী, পল্লী চিকিৎসক আব্দুল খালেককে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসে উপস্থিত হয়। এরপর স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে তালিকা বুঝে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এ সময় হানাদার বাহিনীর একটি দল গ্রামের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে শান্তি কমিটির সভায় না আসা অবশিষ্ট পুরুষদের বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে উপস্থিত হতে বাধ্য করে।

মুক্তিযুদ্ধ
এই মাঠেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করেছিল হানাদাররা। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

সকাল ৯টা তখন। উপস্থিত হাজারো মানুষের চোখে মুখে তীব্র আতঙ্কের ছাপ। কারো মুখে শব্দ নেই। এরইমধ্যে তালিকা ধরে ধরে হিন্দু ও মুসলিমদের আলাদা করে স্থানীয় রাজাকার, পাকিস্তানি সেনা ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।

হিন্দুদের নেওয়া হয় বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে, আর মুসলিমদের নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে। এরপর হিন্দু ও মুসলিম ২ দলকেই কালিমা পড়ানো হয় এবং পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বলা হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আব্দুল আহাদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে এক হানাদার সেনা সবাইকে সোনাদানা-টাকাকড়ি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সবার কাছ থেকে টাকা লুট করে নেওয়ার পর  বেশিরভাগ মুসলিমকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ছাড়া পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিমরা বাড়ির দিকে পালাতে শুরু করেন। ছাড়া না পাওয়া বাকি মুসলিমদের মধ্যে ১০-১২ জনকে স্থানীয় বাজার থেকে নাইলনের দড়ি নিয়ে আসতে বলে হানাদার সেনারা। তারা দড়ি নিয়ে এলে হিন্দুদের সবাইকে শক্ত করে বাঁধার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় কক্ষে থাকা কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন।

এ গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বিদ্যালয়টির শিক্ষক প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, '২৬ তারিখ সকাল ৮টার দিকে স্কুলের মাঠে যাওয়ার কথা থাকলেও আমার একটু দেরি হয়ে যায়। আমি গিয়ে যখন পৌঁছাই ,তখন হিন্দুদের সবাইকে সেই কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখেই ওরা আমাকে ধরে সেই ক্লাসরুমে নিয়ে যায়। যখন তারা বাঁধতে যাবে, তখন সবাই ভয়ে চিৎকার শুরু করে। ক্লাসরুমের একটা জানালা কিছুটা ভাঙা ছিল, কিছুটা  ফাঁকাও ছিল। দেখলাম, প্রাণে বাঁচতে হলে আমার সামনে এটা ছাড়া আর উপায় নেই। আমি জানালাটা ধরে টান দিতেই খুলে গেল। লাফিয়ে জানালা টপকালাম, আর ওরা ব্রাশফায়ার শুরু করল। আমার পর রানু মালাকারসহ আরও কয়েকজন সেখান দিয়ে পালাতে পেরেছিলেন।'

প্রত্যক্ষদর্শী প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

যারা পালাতে পারেননি, তাদের সবাইকে বেঁধে স্কুলের মাঠে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করায় হানাদার সেনারা। এরপর ব্রাশফায়ার শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয় বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ।

বুরুঙ্গা গণহত্যায় ২ বার গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শ্রী নিবাস চক্রবর্তী। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'বৃষ্টির মতো মেশিনগানের গুলি এসে পড়ছিল হাত বাঁধা অসহায় মানুষের ওপর। রক্তের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল লোকগুলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর লোকগুলোর ওপর কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় পশুরা। কেউ নড়াচড়া করলে তাকে আবার গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। আমার বাম হাতে মেশিনগানের গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই আমি মাটিতে মৃতের মতো শুয়ে রইলাম।'

মুক্তিযুদ্ধ
প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজন শ্রী নিবাস চক্রবর্তী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

'ধ্বংসযজ্ঞ শেষে নরপশুরা যখন চলে যায়, তখন কেউ কেউ আহত অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়েছিল । তা দেখে নরপশুরা আবার ফিরে এসে রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে লাগল। সন্দেহবশত আমার পিঠেও গুলি করে। ভাগ্যিস গুলিটা আমার মেরুদণ্ডের উপর চামড়া ভেদ করে চলে গিয়েছিল। তাই আমি বেঁচে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজনের গলার আওয়াজ শুনলাম। হয়তো কোনো আপনজন বা কোনো সাহসী লোক ছুটে এসেছিল। ওই সময় লক্ষ্য করলাম, কিছু লোক পানির জন্য আর্তনাদ করছে। স্কুলের বারান্দায় একটি বালতিতে পানি দেখে তা আমার বৃদ্ধ বাবা নিকুঞ্জ বিহারী চক্রবর্তী ও আরও কয়েকজনকে পান করাই। এই গণহত্যায় আমার বাবা ও ভাই নিত্তরঞ্জন চক্রবর্তীকে চিরতরে হারিয়েছিলাম', যোগ করেন তিনি।

গণহত্যা শেষে পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যায় নিহতদের মরদেহ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। এরপর সেখানে থাকা সিলেট কোর্টের আইনজীবী রাম রঞ্জন ভট্টাচার্যকে চলে যেতে বলে তারা। অসুস্থ রাম রঞ্জন চেয়ার থেকে দাঁড়াতেই তাকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। গণহত্যার পর আহাদ চৌধুরী ও পল্লী চিকিৎসক আবদুল খালেকের নেতৃত্বে রাজাকাররা পুরো গ্রামে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র:

সিলেটে গণহত্যা/ তাজুল মোহাম্মদ

[email protected] 

 

 

Comments